গণভোটের সময়সহ তিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসি নিউজ, (১০ অক্টোবর) : গণভোটের সময়সহ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলেও আগামী ১৫ অক্টোবর সই হবে বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ। ঐকমত্য না হওয়া তিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে এভাবে সুপারিশ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

গতকাল বৃহস্পতিবার কমিশনের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপির মতামত অনুযায়ী ১৯৯১ সালের গণভোট আইনে নয়; সংবিধানের সমতুল্য আদেশ জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করা হবে। প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

সরকার যে তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে তা হলো– গণভোট সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে নাকি আগে হবে, প্রস্তাবের বিষয়ে দেওয়া ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) কীভাবে সমন্বয় করা হবে এবং বর্তমান আইনে নাকি সংবিধানের সমতুল্য আদেশ জারি করা হবে।

কমিশন জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে ১৫ অক্টোবর বিকেল ৩টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদে সই করবেন সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের প্রতিনিধিরা। তারা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে সনদ সই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চায় কমিশন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা শেষে গতকাল কমিশন নিজেদের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বিশ্লেষণ করে। এতে সিদ্ধান্ত হয়, সনদে জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি, সংস্কারের সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকারনামা থাকবে। আগামী ১২ অক্টোবর ইতালি সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। তার আগেই সরকারকে সুপারিশ দেবে কমিশন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও সুপারিশের অনুলিপি দেওয়া হবে। সভার সূত্র জানিয়েছে, কমিশন একাধিক বিকল্প সুপারিশ করবে।

গণভোটে নির্বাচনের সঙ্গে এবং নির্বাচনে আগে আয়োজনের সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরবে। এর ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কখন গণভোট হবে।
নোট অব ডিসেন্টের কী হবে– এ বিষয়ে কমিশন সুপারিশ করবে সরকারকে। কমিশন আগেই জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরামর্শ দিয়েছে– গণভোটের ব্যালটে যেসব সংস্কারে সব দলের ঐকমত্য রয়েছে সেগুলো নিয়ে একটি প্রশ্ন থাকবে। যেসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো জনগণ অনুমোদন করবে কিনা– এ সংক্রান্ত আরেকটি প্রশ্ন থাকবে।

গতকালের বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বিকল্প সুপারিশের চিন্তাও রয়েছে কমিশনের। তা হলো– সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ কার্যকর করা হবে। গণভোটে তা অনুমোদিত হবে। তবে যেসব সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলো আগামী সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যাবে। এসব বিধান রেখে সাংবিধানিক আদেশ জারি হবে ১৫ অক্টোবরের পরে।

কী নিয়ে মতবিরোধ দলগুলোর
গত বুধবার সাত মাসের সংলাপের ইতি টানে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুদক এবং পুলিশ সংস্কারে গঠিত ছয়টি কমিশন ১৬৬ সুপারিশ করে। প্রথম দফার সংলাপে ৬২টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় দফায় ২২ সংস্কারের সুপারিশের ১১টিতে সব দল একমত হয়। ১১ সংস্কারে ভিন্নমতসহ ঐকমত্য ঘোষণা করে কমিশন।

পরের দুই দফায় সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে একমত হয়েছে। তবে গণভোট কখন হবে, এই নিয়ে একমত হতে পারেনি। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো নির্বাচনের দিনে গণভোট চায়। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ কয়েকটি দল সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে, অর্থাৎ নভেম্বরে গণভোট চায়।

জুলাই সনদ সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৯টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার মতো সংস্কার রয়েছে।

বিএনপি বলছে, বিদ্যমান আইনের অধীনে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নোট অব ডিসেন্টসহ গণভোট হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জয়ী দলের যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন না করার এখতিয়ার থাকবে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দলের অবস্থান– সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ কার্যকর করে গণভোট হবে। নোট অব ডিসেন্ট রাখা যাবে না।

সব দলের জন্য ‘উইন উইন সিচুয়েশন’-এর খোঁজ 
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, কমিশন গঠিত হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। কমিশনের দায়িত্ব সরকারকে সুপারিশ করা। গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কমিশন দলগুলোকে একমত করেছে। তাই গণভোট আয়োজনের সুপারিশ সরকারকে করা হবে। কখন কীভাবে গণভোট হবে– এ সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।

এক দিনে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মত সক্ষমতা এবং অবকাঠামো রয়েছে কিনা, তাও সুপারিশে রাখবে কমিশন। একজন সদস্য বলেন, একই সঙ্গে দুটি নির্বাচন  হলে গণনা ও ফলাফলে অনেক সময় লাগবে। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে তা রক্ষার মতো পরিস্থিতি আছে কিনা, তাও দেখতে হবে।

গতকাল নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ সাংবাদিকদের বলেন, গণভোট নির্বাচনের দিনে হওয়া উচিত। ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এ বক্তব্য ক্ষতিকর। এতে মনে হতে পারে, ইসি বিএনপির সঙ্গে মিলে গেছে। সরকারের কর্তৃত্ব নেই। আইনানুযায়ী গণভোট ইসির এখতিয়ারে নেই।

১৯৯১ সালের গণভোট আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৪২(১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গণভোট আয়োজনে রাষ্ট্রপতির নির্দেশপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করে ৪০ দিনের মধ্যে গণভোট করবে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ১৪২(১ক) অনুচ্ছেদ বাতিল করেছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে আদালতের রায়ে অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হওয়ায় ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশ এবং প্রজ্ঞাপনে গণভোট করা যায়।

তবে কমিশনের বিশেষজ্ঞরা সংবিধান আদেশ জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছেন। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনও তা চাইছে। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সব দলের জন্য জয় থাকে, এমন পথ খোঁজা হচ্ছে।

গণভোটের ব্যালটে দুটি প্রশ্ন রাখার পরামর্শ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, একাধিক প্রশ্ন রাখার কথা কেন আসছে? গণভোট হবে জুলাই সনদ অনুমোদন করা হবে কি হবে না– প্রশ্নে।

সালাহউদ্দিন আহমেদও বলছেন, একাধিক প্রশ্ন রাখা অনুচিত হবে। একটি প্রশ্ন থাকবে। নোট অব ডিসেন্টসহ গণভোট হবে। যে দল নির্বাচনে জয়ী হবে, তারা নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংস্কার করবে।

বিএনপি আগে গণভোটের পক্ষে ছিল না। দলটির অবস্থান ছিল, আগামী সংসদে পরবর্তী দুই বছরে সংস্কার হবে। তবে দলটি এখন গণভোটে রাজি। পরবর্তী সংসদে ‘যথাশিগগির সম্ভব’ সংস্কারেও একমত।

জামায়াত ও এনসিপির একাধিক নেতা আশা করছেন, বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন বিষয়েও একমত হবে। কমিশনের একজন সদস্য সমকালকে বলেন, সরকার কাউকে জোর করতে পারবে না। তাই ভালো পথ হলো, সংবিধান আদেশে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিধান রাখা। কোনো দল যদি আগামী সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাদের এই বিধান কার্যকর না করার এখতিয়ার থাকবে।

বিএনপি আগেই জানিয়েছে, তারা সনদে সই করবে। দলীয় প্রতিনিধিদের নামও দিয়েছে। হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, সই করতে চাই বলেই তো এত কষ্ট করেছি। কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কমিশন কী সুপারিশ করে, তা দেখার সিদ্ধান্ত জানাবে জামায়াত। একই অবস্থান জানিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন।

উৎসবের প্রস্তুতি
সংস্কারের সনদকে জুলাইয়ের বড় অগ্রগতি মনে করে সরকার। তাই ১৫ অক্টোবর উৎসবমুখর পরিবেশে সনদ সই অনুষ্ঠান করতে চায়। প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শে অনুষ্ঠান চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র থেকে সরিয়ে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির ৩০ জন এবং অন্যান্য দলের ৫ থেকে ১০ জন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে কমিশন।

আগামী শনিবারও বৈঠকে বসবে কমিশন। গতকালের বৈঠকে ছিলেন আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. আইয়ুব মিয়া ও মনির হায়দার।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ