বেতন কমানোয় পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ-হতাশ
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (২৮ নভেম্বর) : একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্তে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা ও চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্তে আমাদের কষ্ট ও দুর্ভোগ বাড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় এবং পাঁচ ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ২০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত জানান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ভয়াবহ তারল্য সংকটের কারণে এসব ব্যাংক তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, আমানতকারীদের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গভর্নর বেতন-ভাতার ২০ শতাংশ কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা ব্যাংকগুলো লুটপাট করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তাদের দায় দিচ্ছে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর। যাদের কি না ন্যূনতম দায় নেই। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।’
এক্সিম ব্যাংকের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, এমনিতেই গত কয়েক বছর তাদের পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধির নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে তারা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কঠিন লড়াই করে জীবন-যাপন করছেন। এর মধ্যে যদি বেতন কমিয়ে দেয়, তাহলে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দুঃখজনক। যারা ব্যাংকগুলো থেকে লুটপাট করে দুর্বল করে দিল, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা না করে বরং তাদের দুর্নীতির দায় সাধারণ কর্মকর্তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে কর্মকর্তাদের বেতন ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কথারও খেলাপ করেছে। কেননা ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রাথমিক আলোচনায় অন্তত তিন বছর কারও চাকরি যাবে না এবং কারও বেতন কমানো হবে না- এমন ঘোষণাই দেওয়া হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, এমন সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে কর্মকর্তাদের জন্য একটি ‘দুঃখজনক’ বিষয়। তিনি বলেন, ‘যখন রেজলুশন প্ল্যানটি করা হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এই পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক হয়েছিল, তখন কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বেতন কমানোর কোনো কথা ছিল না। আলোচনায় ছিল যে যদি প্রক্রিয়ার মধ্যে কখনো প্রয়োজন হয়, তবে সর্বোচ্চ স্তর থেকে বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হতে পারে। কিন্তু এক মাস না যেতেই কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া হয়, তবে এটি একটি শকিং নিউজ বা দুঃখজনক খবর। আগামীতে চাকরি যাবে না সেই নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারছে না। তবে বড় ধরনের দুর্যোগ তৈরি হলে এর প্রভাব সব জায়গাতেই পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, গভর্নর আগে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, কমপক্ষে দুই-তিন বছর বেতন কমানো হবে না বা চাকরিচুত করা হবে না। তিনি মনে করেন, এখন সেই আশ্বাস থেকে সরে আসাটা আগের ঘোষণার সঙ্গে ‘একটু বৈপরীত্য’ মনে হচ্ছে। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো এখনই না নিয়ে বরং ব্যাংকগুলোর মার্জারের দিকে যখন প্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়া এগোবে, তখন নিলে ভালো হতো।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, তীব্র তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমানতকারী, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও নিজস্ব কর্মীদের পাওনা পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় প্রশাসকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চান। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি প্রয়োজনের ভিত্তিতে আমানতকারী, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিল এবং কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৩২৫ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। এই অর্থ নতুন গঠিত ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ অর্থ থেকে সমন্বয় করা হবে।
বর্তমানে পাঁচ ব্যাংকে ৭৫ লাখ আমানতকারীর জমা আছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা- অর্থাৎ ৭৬ শতাংশ খেলাপি।
খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক, যার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৮ শতাংশ। এরপর রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (৯৭%), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (৯৫%), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (৬২.৩০%) এবং এক্সিম ব্যাংক (৪৮.২০%)।
এসব ব্যাংকে মোট জনবল প্রায় ১৫ হাজার। দেশজুড়ে এই পাঁচ ব্যাংকের রয়েছে ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও ৯৭৫টি এটিএম বুথ।
গত সরকারের আমলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা আমানতকারীদের চাহিদামতো টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বর্তমান সরকার ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নেয়। চলতি মাসের শুরুতে পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং এমডিরা পদত্যাগ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত প্রশাসকরাই এসব ব্যাংকের দায়িত্বে রয়েছেন এবং তারা একীভূতকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।
জানা গেছে, পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে পরিচালনার জন্য ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে শরিয়াহভিত্তিক নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রাথমিক লাইসেন্স পেয়েছে। এ ব্যাংকের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগানের প্রস্তাব দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন ব্যাংকের হিসাব খোলা হলে অর্থ বিভাগ সেই হিসাবে অর্থ ছাড় করবে।
মনোয়ারুল হক/
