নির্বাচনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৯০ হাজার সেনা মাঠে থাকবে
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (২৮ নভেম্বর) : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল ঘোষণার প্রথম দিন থেকেই আচরণবিধি প্রতিপালন, অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের ওপর কঠোর নজরদারি এবং অপতথ্য মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ- সবই থাকবে কড়া পর্যবেক্ষণে। গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে দেশের সব বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সভায় এই অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক থেকেই মূলত নির্বাচনের নিরাপত্তা-পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণ হয়। বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র সচিব, ইসি সচিবসহ বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে সভা শেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য রাখা হয়নি। নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ইসির পরিকল্পনার চূড়ান্ত ছক বা পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান সংস্থাটির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।
ইসি সচিব জানান, দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন উপলক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা এই বৈঠকে মোট ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সবের মধ্যে রয়েছে- অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া, মনোনয়ন দাখিল থেকে প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত নিরাপত্তা, পোস্টার-ব্যানার অপসারণ, ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনি এলাকার নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার সহায়তা, সিসিটিভি স্থাপন ও লাইভ মনিটরিং, ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ, বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা, পোস্টাল ভোটিংয়ের নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপতথ্য মোকাবিলা। ইসি বলছে, এসব ইস্যুই নিরাপদ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।
নিরাপত্তায় ৩ স্তরের ব্যবস্থা
ইসির সভায় জানানো হয়, এবারের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র থেকে শুরু করে গোটা নির্বাচনি এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হবে। প্রথম স্তরে থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স, যারা প্রতিটি কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করবে। দ্বিতীয় স্তরে থাকবে মোবাইল ফোর্স, যারা কেন্দ্রভিত্তিক ও আশপাশের এলাকায় টহল দেবে এবং যেকোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাবে। তৃতীয় স্তর হিসেবে রাখা হবে সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স, যারা জরুরি পরিস্থিতি কিংবা সহিংসতা সম্ভাব্য এলাকায় দ্রুত পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মূল্যায়নে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন- এই তিন ভাগে বিভক্ত করে মোতায়েন কৌশল সাজাতে আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন সিইসি।
আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর বার্তা
ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানান, তফসিল ঘোষণার পর প্রথম দিন থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে কঠোর অবস্থানে মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, সমর্থক- সবাইকে একই মানদণ্ডে রাখা হবে। নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে থাকা-খাওয়াসহ কোনো ধরনের সুবিধা না নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা অবহেলার ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা হবে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যত্যয় বা শিথিলতা বরদাশত করা হবে না।
মাঠে থাকবে ৯০ হাজার সেনা
এবার প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের জন্য ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে থাকবে ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি ভোটকক্ষ। বিশাল এই কাঠামোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠে থাকবেন ৭ লাখেরও বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। এর মধ্যে আনসার-ভিডিপির সদস্য থাকবেন সাড়ে ৫ লাখের বেশি; পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থাকবে সমন্বিতভাবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা শক্তি হিসেবে ৯০ হাজারের বেশি সেনা সদস্য ১৭ দিন মাঠে থাকবেন। তারা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী- সব শাখার সমন্বয়ে গঠিত এই বাহিনী রিজার্ভ ও স্ট্রাইকিং উভয় ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। ভোটের আগে-পরে আট দিনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব আগেই এসেছে; এবার সেটিই বাস্তবায়নের পথে।
অপতথ্য সাইবার সিকিউরিটি সেল
ডিজিটাল যুগে নির্বাচনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ অপতথ্য, গুজব ও ভয়েস ক্লোন প্রযুক্তি- এ কথা মাথায় রেখে সাইবার সিকিউরিটি সেল এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজরদারিতে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। এখানে ইউএনডিপির প্ল্যাটফর্মসহ তথ্য মন্ত্রণালয়, সিআইডি, এনটিএমসি ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বিত সক্ষমতা ব্যবহার হবে। ইসি সচিব বলেন, অপতথ্য মোকাবিলায় দ্রুত ‘ভালো তথ্য’ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সন্ত্রাসী শনাক্তকরণ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। চিহ্নিত সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, অস্ত্রধারী ও নাশকতাকারীদের তালিকা আগেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে সীমান্ত ও সমুদ্রপথ সিল করে দেওয়া হবে। নির্বাচনপূর্ব অশান্তির সম্ভাবনা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই- এসব প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোরতায় কাজ করবে বাহিনী।
ভোটকেন্দ্রে ১৩-১৮ জন সদস্যের নিরাপত্তা বলয়
একেকটি ভোটকেন্দ্রে কমপক্ষে ১৩ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ জন নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন থাকবেন। এদের মধ্যে আনসার, পুলিশ, মোবাইল টিম ও রিজার্ভ ফোর্সের সদস্য থাকবেন। পোস্টাল ভোটিংয়ের নিরাপত্তা থেকে রিটার্নিং অফিসারের বাসস্থান পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে।
সভায় ইসির প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচন। সেই লক্ষ্যেই তারা মাঠে নামাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় সমন্বিত নিরাপত্তা কাঠামো।
মনোয়ারুল হক/
