তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (২৮ নভেম্বর) : বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সম্ভাব্য ও ঘোষিত প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় হলেও দলটি এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। সেগুলো হলো তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং মনোনয়ন ঘিরে দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব।
যাচ্ছে, তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন বা কেন এত দেরি হচ্ছে, সেসব প্রশ্ন দলের অভ্যন্তরে উদ্বেগ তৈরি করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৫ মাস কেটে গেলেও তারেক রহমানের দেশে না ফেরার ব্যাখ্যা কেউ নিশ্চিতভাবে জানেন না। তার সব মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং ঢাকায় তার জন্য বাড়ি প্রস্তুত করা ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে একাধিক খবর এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। তার পরও তিনি কেন আসছেন না, তা নিয়ে দলের ভেতরেই নানা ব্যাখ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারেক রহমান ফিরবেন। তবে তফসিলের আগে কেন ফিরবেন না, সে প্রশ্নের জবাব কারও কাছে নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসিকে জানান, তফসিল ঘোষণার পরও যদি তার ফেরায় বিলম্ব হয়, তাহলে দলে বিদ্যমান সন্দেহ আরও বাড়বে এবং এটি বিএনপির জন্য নতুন সংকট তৈরি করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ নভেম্বরের মধ্যেই তারেক রহমানের দেশে ফেরার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। তবে নভেম্বর শেষ হতে চললেও দলটি এখনো তার ফেরার তারিখ ঘোষণা করতে পারেনি। ফলে দলে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়েও দলের ভেতরে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু এ ঘোষণায় দেশজুড়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের উদ্বেগ কাটেনি। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী, তিনি নতুন করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তার হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে এবং মেডিকেল বোর্ড সার্বক্ষণিক তদারকি করছে।
দলের শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন আশা প্রকাশ করেছেন, খালেদা জিয়া দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন এবং সামনে থেকে দলের নেতৃত্ব দেবেন। তবে দলের বিভিন্ন স্তরে তার শারীরিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ স্পষ্ট। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার সুস্থতা কামনায় দোয়া-মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, সংকটকালে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পেছনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এখন বিএনপির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তাই তার অসুস্থতা নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) সরাসরি নেতৃত্ব দিতে না পারলেও তাকে সামনে রেখেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। কারণ তিনিই দলটির ঐক্যের প্রতীক। অসুস্থ থাকলেও তিনি আছেন এবং এটিই দলটির জন্য বড় শক্তি। খালেদা জিয়া না থাকলে পরিস্থিতি কী হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’
এদিকে এই দুই অনিশ্চয়তা ছাড়াও তৃতীয় আরেকটি সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিএনপির ভেতরে। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার পর দেখা যাচ্ছে, ৫০টির মতো আসনে স্থানীয় নেতারা মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। কোথাও সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, মিছিল; কোথাও প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে টানা বিক্ষোভ হয়েছে। বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পারা এসব এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্ব ক্রমেই জটিল হচ্ছে।
এ ছাড়া সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যে আসনগুলো বিএনপি শূন্য রেখেছে, সেগুলো নিয়েও বিরোধ তৈরি হয়েছে। অনেক এলাকায় স্থানীয় নেতারা নিজেদের আসন অন্যদের দিতে নারাজ। এর ফলে নতুন করে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এসব পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাম তিনটি আসনে রাখার বিষয়টিও কারও কারও মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যারা আগে ধরে নিয়েছিলেন তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না, তারাও এখন আবার নতুন করে ভাবছেন বিএনপি তাকে সামনে রেখে নির্বাচনে যেতে চাইছে।
মনোনয়নসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে দলের ভেতরে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এসব দ্বন্দ্ব শিগগিরই কাটবে এবং নেতা-কর্মীরা সবাই মিলে দলীয় প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন।
তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সভাতেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেসব আসনে অভিযোগ আছে বা যেখানে আরও যোগ্য প্রার্থী আছেন, সেসব এলাকায় মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সব মিলিয়ে বিএনপি এখন এক জটিল সমীকরণের মধ্যে রয়েছে। দলের শীর্ষ দুই নেতাকে ঘিরে অনিশ্চয়তা, মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় অস্থিরতা এবং নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দমন করার চাপ- সবই প্রভাব ফেলছে। দলটি সামনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে এসব সংকট কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে, তা এখন তাদের জন্য বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব বিষয়কে সংকট হিসেবে দেখতে নারাজ। তিনি মনে করেন, বিএনপি বড় দল। আর বড় দলে এ রকম সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। সূত্র: বিবিসি
মনোয়ারুল হক/
