বিদায়ের সঙ্গে শেষ হলো এক আপসহীন রাজনৈতিক মহাকাব্যের অধ্যায়

বিশেষ প্রতিনিধি, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা (৩০ ডিসেম্বর) : একটি নাম—বেগম খালেদা জিয়া। এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সংঘাত, ক্ষমতা, কারাবাস, অসুস্থতা এবং শেষ পর্যন্ত নীরব বিদায়। মঙ্গলবার ভোরে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমাপ্তি ঘটল এমন এক অধ্যায়ের, যা চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য, বিরোধী রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক লড়াইকে সংজ্ঞায়িত করেছে।

দীর্ঘদিন অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে ভোরের নিস্তব্ধতায় তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। মৃত্যুর মুহূর্তে পাশে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা—একটি রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রহরে ব্যক্তিগত জীবনের নীরব উপস্থিতি।

খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। কোনো রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নয়, কোনো আন্দোলনের মিছিলে বেড়ে ওঠা নয়—তবু রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যাওয়া এক বিরল রাজনৈতিক যাত্রা তার। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও, অল্প সময়েই তিনি নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণ করেন।

তার নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। আবার তার বিরোধিতার মুখেও পড়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিকূলতা। আন্দোলন, নির্বাচন, বর্জন, গ্রেপ্তার, মুক্তি—সব মিলিয়ে তার জীবন ছিল টানাপোড়েনের এক দীর্ঘ উপাখ্যান। সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন “আপসহীন নেত্রী”, আর বিরোধীদের কাছে কঠোর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।

কারাবাস ও অসুস্থতা তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায়কে আরও বেদনাদায়ক করে তোলে। একসময় যিনি রাজপথের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, তিনি ধীরে ধীরে বন্দি হয়ে পড়েন হাসপাতালের কক্ষ ও আদালতের কাগজে। তবু তার নাম মুছে যায়নি রাজনীতির কেন্দ্র থেকে—বরং অনুপস্থিতিতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরও প্রতীকী।

তার মৃত্যুর খবরে বিএনপি সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে। কিন্তু শোক শুধু একটি দলের নয়—এটি একটি সময়ের, একটি ধারার, একটি দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক ইতিহাসের শোক। জানাজা অনুষ্ঠিত হতে পারে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে—যেখানে অতীতে বহু রাজনৈতিক সমাবেশ ইতিহাস গড়েছে।

খালেদা জিয়ার মৃত্যু প্রশ্ন রেখে যায় বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও। নেতৃত্বের শূন্যতা, আদর্শের উত্তরাধিকার, বিরোধী রাজনীতির পথ—সবকিছুই এখন নতুন করে ভাবার সময়।

তিনি আর নেই, কিন্তু তার রাজনৈতিক উপস্থিতি ইতিহাসে রয়ে যাবে। প্রশংসা ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে বলা যায়—খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এমন এক চরিত্র, যাকে বাদ দিয়ে এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা অসম্ভব।

একটি মহাকাব্যের মতো জীবন, আর তার শেষ হলো নীরবতায়।

মনোয়ারুল হক/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ