মায়ানমারে নির্বাচনকে ঘিরে ভয়ের ছায়া

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসিনিউজবিডি, (২৮ ডিসেম্বর) : ইরাবতী নদীর ধারে রুক্ষ একটি জমিতে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী তাইজা কিয়াও তার শ্রোতাদের মধ্যে কিছুটা উৎসাহ জাগানোর চেষ্টা করছেন। তিনি তাদের সামনে বক্তব্য দিয়ে ভালো দিনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

তিনি মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) প্রার্থী। মান্দালয় শহরের আউংমেয়থাজান আসন থেকে তিনি নির্বাচনে লড়ছেন। ৩০০ থেকে ৪০০ জনের একটি ভিড় দলের লোগোযুক্ত টুপি ও পতাকা হাতে আঁকড়ে ধরে আছেন। কিন্তু বিকেলের তীব্র গরমে খুব দ্রুতই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েন।

চেয়ারের সারির ফাঁকে ফাঁকে শিশুরা দৌড়ঝাঁপ করছে। উপস্থিত অনেক পরিবারই মার্চ মাসে মান্দালয় ও আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনা ভূমিকম্পের শিকার। তারা মূলত কোনো সহায়তার আশায় এসেছেন। সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সরে পড়েন।

রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) মায়ানমারের মানুষ প্রায় পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তার পর এই প্রথম ভোট হচ্ছে।

তবে সামরিক জান্তার অধীনে হতে চলা এ নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলে নিন্দা করা হচ্ছে। এমনকি জুটেছে জালিয়াতির তকমাও। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং দলটির নেতা অং সান সু চি অজ্ঞাত স্থানে একটি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।

এক মাসের মধ্যে তিন ধাপে ভোট গ্রহণ হওয়ার কথা। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বড় অংশে আদৌ ভোট দেওয়াই সম্ভব হবে না। যেসব এলাকায় ভোট হচ্ছে, সেখানেও ভয় ও ভীতি প্রদর্শনের পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

মান্দালয়ের ওই সমাবেশে বিবিসি যখন লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল তারা নির্বাচন সম্পর্কে কী ভাবছেন, তখন দলীয় কর্মকর্তারা আমাদের থামিয়ে দেন। একজন ব্যাখ্যা করেন, তারা ভুল কিছু বলে ফেলতে পারেন, তারা জানেন না সাংবাদিকদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়।

সমাবেশে উপস্থিত অসংখ্য সাদাপোশাকের সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার উপস্থিতিই তাদের এই ভয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে। এমন এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, যেখানে নির্বাচন সমালোচনাকারী কোনো ফেসবুক পেজে লাইক দেওয়া বা ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে সামরিকপন্থি এই দলের কর্মীরাও বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের সুযোগ দিতে ভয় পাচ্ছিলেন।

মান্দালয়ের রাস্তাঘাটেও একই ভয়ের ছায়া। নদীর টাটকা মাছ বিক্রির এক দোকানে ক্রেতারা কেউই নির্বাচন নিয়ে মত দিতে রাজি হননি। একজন বললেন, ‘আমাদের কোনো বিকল্প নেই, তাই ভোট দিতে হবে। মাছ বিক্রেতা আমাদের তাড়িয়ে দেন।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাকে বিপদে ফেলবেন।’

শেষ পর্যন্ত একজন নারী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সাহস করে খোলাখুলি কথা বলতে রাজি হন। তবে তার সঙ্গে দেখা করতে হয় নিরিবিলি জায়গায়। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন একটা মিথ্যা। সবাই ভয়ে আছেন। সবাই তাদের মানবিকতা ও স্বাধীনতা হারিয়েছেন। এত মানুষ মারা গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন বা অন্য দেশে পালিয়ে গেছেন। সেনাবাহিনী যদি দেশ চালিয়েই যায়, তাহলে পরিবর্তন আসবে কীভাবে?’

তিনি বলেন, তিনি ভোট দেবেন না। তবে তিনি জানেন, সেই সিদ্ধান্তও ঝুঁকির সঙ্গে জড়িত। সূত্র: বিবিসি

মনোয়ারুল হক/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ