তরুণদের প্রাধান্য থাকছে বিএনপির ইশতেহারে

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (২৭ নভেম্বর) : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনি ইশতেহার চূড়ান্ত করার কাজে হাত দিয়েছে বিএনপি। দলটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এবারের ইশতেহারে তরুণ প্রজন্মকে প্রধান্য দিয়ে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা এবং জুলাই সনদ ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ইশতেহার চূড়ান্ত করার শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। এই চার দফার আলোকে সমন্বিত ইশতেহার নির্বাচনি প্রচারে নতুন গতি এনে দেবে বলে মনে করছে বিএনপির হাইকমান্ড।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে বর্তমান জেন জি অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপার। ইশতেহারে তরুণ প্রজন্মের জন্য যে অংশটি রয়েছে, সেখানে ‘তারুণ্যের রূপরেখা’ শব্দটি গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করছে বিএনপি। সারা দেশে তারুণ্যের সেমিনার থেকে উঠে আসা মতামতকে ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই অংশে তরুণদের কর্মসংস্থানসহ তাদের নিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ থাকবে। এ ছাড়া ইশতেহারে আলেম-ওলামা, সংখ্যালঘু, যুবক, কৃষক ও নারীদের জন্য থাকবে বিশেষ প্রতিশ্রুতি। এ ছাড়া দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও থাকবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রতিটি সেক্টরের ওপর পৃথকভাবে ইশতেহার তৈরি করার জন্য বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে ইশতেহারে শেষ মূহূর্তের সংযোজন ও বিয়োজনের কাজ চলছে। সব সেক্টরের প্রতিবেদন একত্র করেই চূড়ান্ত ইশতেহার তৈরি করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করা হবে।

সূত্র আরও জানায়, ইশতেহার ও লিফলেটের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জনগণের মাঝে বিশদ আকারে তুলে ধরার জন্য শিগগিরই কর্মশালার আয়োজন করতে যাচ্ছে বিএনপি। এই কর্মশালায় কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি সব অঙ্গ ও সংযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা শেয়ার করা হবে। তাদের মাধ্যমে বিএনপির পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজ চলমান আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কাজ করছেন। দেশবাসীর সামনে এটা পার্টির আগামীর দিনের প্রতিশ্রুতি। ইশতেহার তৈরির কাজ শেষ হলে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।’

সূত্র আরও জানায়, বিএনপি মনে করে- বড় আকারের নির্বাচনি ইশতেহার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। জনগণের মধ্যেও এ ধরনের ইশতেহারের তেমন প্রভাব পড়ে না। এ জন্য ইশতেহারের মূল বিষয়বস্তু সারসংক্ষেপ আগেভাগে লিফলেট আকারে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি ইশতেহার পুস্তক ছাপানো হবে। ইশতেহারের আলোকে নারী, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, কৃষি ও খাদ্য, শিল্প খাত, প্রশাসনসহ সব সেক্টরের ওপর পৃথক লিফলেট নিয়ে তফসিল ঘোষণার আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারে নামবে বিএনপি। সারা দেশের মানুষের হাতে হাতে লিফলেট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য দলটির।

বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, ইশতেহার এবং নির্বাচনি প্রচারে কী কী বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়ে নেতারা মতামত দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একজন উপদেষ্টা বলেন, ‘এবার ইশতেহারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শে তরুণ প্রজন্মকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে সংযোজন-বিয়োজন করছি।’

দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য ইশতেহারে চূড়ান্তভাবে প্রতিফলিত হবে। তফসিলের পর একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইশতেহার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

সূত্র জানায়, এবারের ইশতেহারে তারেক রহমানের ৩১ দফার আলোকে নির্বাচনি শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, মানবাধিকার রক্ষা ও দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ৩১ দফা থেকে ইশতেহারে যুক্ত হচ্ছে- প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; বিশিষ্ট নাগরিক ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইন সভা’ প্রবর্তন; স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বাতিল; ইভিএম নয়, পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত; বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন এবং বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন; বিগত ১৫ বছরের অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ; পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নির্যাতনের অবসান ঘটানো; ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কূটনীতিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া।

এ ছাড়া জুলাই জাতীয় সনদের আলোকে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা দেওয়ার পরিকল্পনাও ইশতেহারে গুরুত্ব পাবে।
বিএনপির নির্বাচনি ইশতেহারে আলেম-ওলামা, হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যুবক, কৃষক, নারী ও প্রবীণ নাগরিকদের জন্য আলাদা প্রতিশ্রুতি থাকছে। কওমি মাদ্রাসার উন্নয়ন, ইসলামিক গবেষণার জন্য তহবিল গঠন, ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকায়ন ও ধর্মচর্চার বাধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকবে। ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল রোধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, নিরাপত্তা সেল, উৎসবে রাষ্ট্রীয় সহায়তা এবং সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে কঠোর কার্যক্রম চালুর প্রতিশ্রুতি যুক্ত হবে।

যুবসমাজকে টার্গেট করে ইশতেহারে বিএনপি বড় পরিসরে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি যুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৮ মাসের মধ্যে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রতিটি জেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান, স্টার্টআপ ফান্ড স্থাপন, আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ, বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি ও মাদকবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন। আলিবাবা, আমাজনসহ বিশ্বে ই-কমার্সে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি, আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্সারদের লেনদেন নিরাপদ করতে পেপাল ও ওয়াইল্ড চালু করার প্রতিশ্রুতি যুক্ত হচ্ছে ইশতেহারে।
নারীর নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিল গঠন, মাতৃত্বকালীন ভাতা বৃদ্ধি এবং সহিংসতা প্রতিরোধে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন- এগুলোও ইশতেহারে যুক্ত হচ্ছে। ৫০ লাখ ফ্যামিলি কার্ড, বয়স্ক ভাতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শক্তিশালী করার অঙ্গীকারও ইশতেহারে যুক্ত হবে।

ইশতেহারে পরিবেশ রক্ষায় শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খাল ও নদী খননের কর্মসূচি পুনরায় চালু ও পাঁচ বছরে পাঁচ কোটি গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি থাকছে।

কৃষি ও কৃষককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এবার ইশতেহার তৈরি করছে বিএনপি। কৃষকদের ডিজিটাল পরিচয়পত্র; কৃষি উপকরণের দাম কমানো, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, কৃষিঋণ সহজ করা, ধান-চাল কেনার স্বচ্ছ ব্যবস্থা করা; ২০ হাজার কিলোমিটার নদী ও খাল পুনরুদ্ধার; সম্প্রদায়ভিত্তিক সেচব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং আধুনিক তিস্তা ও গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ; ‘অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং’ ধান চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ; প্রতিটি জেলায় কোল্ডস্টোরেজের সংখ্যা বাড়ানো; জাতীয় ‘সার্কুলার ইকোনমি’ মডেলে রিসাইক্লিং হাব, বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র ও প্লাস্টিক, ই-বর্জ্য ও কৃষি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে উৎপাদনে রূপান্তর করা; উন্নত মানের বীজ, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সরাসরি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে যুক্ত হচ্ছে।

ইশতেহারে শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্য বাজেট বাড়ানো; স্কুল থেকেই ব্যবহারিক ও কারিগরি শিক্ষা চালু যেমন- স্কুল পর্যায়ে আইটি, খেলাধুলা, আর্ট কালচার, ডেন্টাল হাইজিন, মেডিকেল টেকনিশিয়ান; প্রাইমারি থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি আরবি, জার্মান, ফরাসি, জাপানি ও চীনা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ; বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা; হলের আবাসন সংকট নিরসন, লাইব্রেরি আধুনিকায়নসহ ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি থাকছে।

ইশতেহারে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে যুক্তরাজ্যের (ইউকে) ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচসি) আদলে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা’; প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা; স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি বরাদ্দ; প্রতিটি গ্রামে একাধিক পল্লিচিকিৎসক নিয়োগ; চিকিৎসা গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত; ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন; জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত স্তরের স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ; চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত করার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি (এক থেকে তিন বছর), মধ্যমেয়াদি (এক থেকে পাঁচ বছর) এবং দীর্ঘমেয়াদি (১০ বছর পর্যন্ত) প্রতিশ্রুতি থাকছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন, বিচার বিভাগ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯টি দফায় নানা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে ইশতেহার ঘোষণা করেছিল বিএনপি।

মনোয়ারুল হক/

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ