দুদকের অনুসন্ধান : দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের জন্য এক দিনেই ৭৭ জনকে বদলি
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসি নিউজ, (৭ অক্টোবর) : নীতিমালা লঙ্ঘন করে বদলি বাণিজ্য, বিভাগীয় বন অফিস থেকে চাঁদা আদায়, নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। এক অভিযানে এসবের বেশ কয়েকটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই অভিযানে নিয়ম লঙ্ঘন করে এক দিনেই সাতটি আলাদা আদেশে ৭৭ কর্মচারীকে বদলির তথ্য পাওয়া যায়, যাতে অবৈধ লেনদেনের যোগসূত্র জানতে পেরেছে দুদক টিম।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির অভিযানিক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে এখন বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নিয়মিত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। কমিশনের উপ–পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এই বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এসেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান টিমের সুপারিশের প্রেক্ষিতে আইন অনুযায়ী কমিশন একটি নিয়মিত অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
দুদক থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক কার্যালয়ে নানাবিদ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের তিন সদস্যের একটি অভিযান টিম অভিযান চালায়। দুদকের সহকারী পরিচালক সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এ আভিযানিক টিম বন কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করে। একই সঙ্গে এ কার্যালয়ে বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমকে ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর কাছ থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নানা নথিপত্র সংগ্রহ করেন দুদক কর্মকর্তারা।
পরবর্তী সময়ে নথিপত্র বিষয়ে যাচাই–বাছাই করার পর বেশকিছু অভিযোগের সত্যতা পায় আভিযানিক দল। এরই মধ্যে এই বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়ম–দুর্নীতির আরও বেশকিছু অভিযোগ আসে দুদকের হাতে। পরে অভিযানিক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে এসব অভিযোগের বিষয়ে নিয়মিত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ তিনি অধীনস্থ কতিপয় কর্মকর্তার মাধ্যমে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। তিনি নীতিমালা লঙ্ঘন করে গত ৯ জানুয়ারি এক দিনেই সাতটি আলাদা আদেশে ৭৭ কর্মচারীকে বদলি করেন। তাঁদের মধ্যে ফরেস্ট গার্ড, ফরেস্টার, নৌকাচালক ও ডেসপাস রাইডার রয়েছেন।
এ ছাড়া মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে বনের ১০টি বিভাগীয় অফিস থেকে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় এবং সুফল প্রকল্পের বাগান, বাগান রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন ও ক্রয়ের কাজ থেকে ৫ শতাংশ কমিশন গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ফরেস্ট একাডেমির পরিচালকের পদে থেকে ৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে নিজস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএমএম ট্রেডার্সকে কাজ দিয়ে ফরেস্টার আব্দুল হামিদের মাধ্যমে কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগও পেয়েছে দুদক।
দুদকের আভিযানিক দলের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ এক দিনের মধ্যে অধিকসংখ্যক বদলির আদেশ অস্বাভাবিক। বদলির ক্ষেত্রে নীতিমালা, ২০০৪ পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। প্রতিটি বিভাগে পছন্দের লোক রেখে কম সময় চাকরি করা ব্যক্তিদের বদলি করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে দুদক জানতে পারে যে, এই বদলি বাণিজ্যে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে। ঘুষ তথা অর্থের বিনিময়ে বদলি বাণিজ্যের বিষয়টি সমন্বয় করেন মোল্যা রেজাউল করিমের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম ফরেস্ট একাডেমির ফরেস্টার আব্দুল করিম। প্রতিটি রেঞ্জ অফিস, চেক স্টেশন ও বনবিট থেকে মাসিক চাঁদা আদায়, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কমিশন আদায় ইত্যাদি কাজের জন্য এই বন সংরক্ষক বিশ্বস্ত লোকদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ বাহিনী রয়েছে।
এ বাহিনীর সদস্যেরা বদলি বাণিজ্য, অধস্তর বিভিন্ন অফিস থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কমিশন আদায় করে সেই টাকা মোল্যা রেজাউলের আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক হিসাবে পৌঁছে দেন বলেও দুদকের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে একাডেমির ডরমেটরি ভেঙে নিজের বাসস্থান তৈরি, সৌন্দর্য বর্ধনের নামে অপ্রয়োজনীয় ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ, সামাজিক বন বিভাগ ফেনীর বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাগান সৃজন না করে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় বলে দুদকের এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে সেগুন বাগান বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, বান্দরবান, রাজশাহী, যশোর, বাগেরহাট, মিরপুর জাতীয় উদ্যান ও টিকাটুলি বলদা গার্ডেনের দায়িত্ব পালনকালে নানা অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেল ঢাকায় দায়িত্ব পালনকালে বনের জমি বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। এই বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে রাজধানীর লালমাটিয়ায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট, ধানমন্ডিতে তাঁর স্ত্রীর নামে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, সাতক্ষীরার তালা থানাধীন বাগমারা নিজের গ্রামে তাঁর বাবার নামে আমবাগনসহ ২০ বিঘা জমি ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের অভিযান দলের প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের স্বপক্ষে উপাদান থাকায় তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রকাশ সম্পদের অনুসন্ধানের সুপারিশ করা হলো।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, ‘এগুলো সত্য নয়। এসব অভিযোগ বানোয়াট।’ এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগগুলোর স্বপক্ষে নথিপত্র থাকলে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে কোনো আপত্তি নেই বলেও জানান তিনি।