মায়ের দুধই শিশুর শ্রেষ্ঠ পুষ্টি, বিকল্প খাদ্যে বাড়ছে ঝুঁকি

লাইফস্টাইল ডেস্ক, এবিসি নিউজ, ঢাকা (৪ অক্টোবর) : আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ-এই বাক্যটি শুধুই কাগজের বুলি নয়, বরং একটি জাতির সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। একটি সুস্থ ও শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে জন্মের পর থেকেই শিশুর প্রয়োজন যথাযথ যত্ন, সুরক্ষা ও সর্বোপরি সুষম পুষ্টি। জন্মের পর শিশুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য খাদ্য হলো মায়ের বুকের দুধ। এতে আছে প্রাকৃতিকভাবে প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান, যা কোনো কৃত্রিম বা বিকল্প খাদ্যে পাওয়া সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। এরপর পরিপূরক খাদ্য যুক্ত করলেও দু’বছর বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ চালু রাখা উচিত। মায়ের দুধে রয়েছে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি, এনজাইম, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং নানা ধরনের হরমোন, যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নগর জীবনের কর্মব্যস্ততা এবং সচেতনতার অভাবে অনেক মা সন্তানকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না। রাজধানীর মিরপুরে বসবাসকারী সালমা আক্তার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিসে থাকার কারণে তার পক্ষে নিয়মিত সন্তানের বুকের দুধ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তাই পাঁচ মাস বয়সী ছেলেকে তিনি গুঁড়ো দুধ খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্র্যান্ড হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ‘নেসলে ল্যাক্টোজেন-১’, যার প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে ‘জন্ম থেকে দেয়া যায়’!

এমনকি শিশুর জন্য ব্যবহৃত ফিডারের গায়ে বড় করে লেখা ‘For Angel’, যা শুনতে আকর্ষণীয় হলেও আদতে বিভ্রান্তিকর।

এই ধরনের বিজ্ঞাপন এবং মোড়কের তথ্য দেখে অনেক মা-বাবা ধরে নেন গুঁড়ো দুধ মায়ের দুধের চমৎকার বিকল্প। বাস্তবে চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, গুঁড়ো দুধের ব্যবহারে শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে বিশুদ্ধ পানি ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে গুঁড়ো দুধ প্রস্তুত না করায় শিশুরা সহজেই ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েডসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিকল্প শিশুখাদ্যের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপুষ্টির হারও। অথচ এই বিষয়ে রয়েছে স্পষ্ট আইন।

২০১৩ সালের ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য বিক্রয় ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইন’ অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি বা দোকান গুঁড়ো দুধ বা বিকল্প শিশুখাদ্য পণ্যের প্যাকেটে এমন কিছু লিখতে পারবে না বা প্রচার করতে পারবে না, যা মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করে। বরং বাধ্যতামূলকভাবে পণ্যের গায়ে লিখতে হবে:

‘শিশুর জন্য মায়ের দুধের সমতুল্য বা শ্রেষ্ঠতর কোনো খাদ্য নেই’ এবং ‘এই খাদ্য সম্পূর্ণ রোগজীবাণুমুক্ত নয়, এটি খেলে শিশুর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

কিন্তু রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তের বাজারে গেলে দেখা যাবে, এসব আইন কাগজেই রয়ে গেছে। সুপারশপ কিংবা রাস্তার পাশে দোকান- প্রায় সর্বত্রই মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য প্রদর্শন ও বিক্রি হচ্ছে নিয়ম না মেনেই। অনেক দোকানদারই জানেন না এই পণ্য প্রদর্শন বা প্রচারের নিয়ম-কানুন কী। একইভাবে বেশিভাগ ক্রেতাও জানেন না মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছু শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে যেসব বিকল্প শিশুখাদ্য রয়েছে, সেগুলো সাধারণত দু’ধরনের- একটি হলো ‘ইনফ্যান্ট ফর্মুলা’, যা শিশুর জন্ম থেকে ছয় মাস পর্যন্ত ব্যবহারের কথা বলা হয়। অন্যটি হলো ‘ফলো-আপ ফর্মুলা’, যা ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য, মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এগুলো ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

জাতীয় শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দু’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর বিকাশের জন্য মায়ের দুধই যথেষ্ট। বিকল্প দুধ বা খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। বরং এসব বিকল্প দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং বারবার অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।’

শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই মাতৃদুগ্ধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা। ১৯৮১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) ও ইউনিসেফ যৌথভাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস’ তৈরি করে। বাংলাদেশ সেই কোডের ভিত্তিতে ১৯৮৪ সালে আইন প্রণয়ন করে এবং সর্বশেষ তা সংশোধন হয় ২০১৩ সালে। সংশোধিত আইনে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য বিকল্প খাদ্যের বিপণন নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়।

বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) সরকার ও বিভিন্ন অংশীদারের সহযোগিতায় এই আইনের বাস্তবায়ন ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে। সাবেক চেয়ারপারসন এস কে রায় জানান, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ শিশু জন্মায়। ফলে দেশে দু’বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখে দাঁড়ায়। এই বিপুল সংখ্যক শিশুকে নিয়মিত মায়ের দুধ নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ।

তিনি বলেন, ‘সচেতনতার অভাব, প্রচার কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা এই কাজে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকার বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, পাশাপাশি বিবিএফ ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান একটি পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।’

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, যতই আইন থাকুক না কেন অভিভাবক সচেতন না হলে শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা কঠিন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্যকর্মী, পুষ্টিবিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। মাতৃদুগ্ধকে প্রতিস্থাপন নয়, উৎসাহিত করতে হবে সর্বত্র।

একটি শিশুর জন্য তার মা হচ্ছেন প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পুষ্টিবিদ। তার বুকের দুধ শুধু খাদ্য নয়, জীবনের বীজতলা। বিকল্প দুধ শিশুকে সাময়িকভাবে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে, কিন্তু কখনো তার ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

তাই আজকের দিনের ডাক- ‘মায়ের দুধে গড়ি শিশুর ভবিষ্যৎ, বিকল্পে নয়।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ