ব্যাংক একীভূত হলে ২ লাখ টাকার কম আমানত একবারেই ফেরত পাবেন গ্রাহকরা
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসি নিউজ, (৭ অক্টোবর) : বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরম সংকটে পড়েছে। খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, পুঁজির ঘাটতি এবং কিছু ব্যাংকের প্রশাসনিক দুর্বলতা এই খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক—অর্থনৈতিকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এগুলোকে আর আলাদাভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার মিলে একটি বড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে—এই পাঁচটি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে, যার নাম হবে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। লক্ষ্য হলো—ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং দেশের আর্থিক কাঠামোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
নতুন ব্যাংকটি হবে শতভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত, এবং এটি পরিচালনা করবে অভিজ্ঞ ব্যাংকার, শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিচালনা পর্ষদ। পুরোনো পাঁচটি ব্যাংকের মালিকদের শেয়ার সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হবে, তবে তাদের ঋণ ও দায় নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে। কারণ, এই ব্যাংকগুলোর নিট সম্পদ বর্তমানে ঋণাত্মক, যার ফলে পুরনো শেয়ারের আর কোনো প্রকৃত মূল্য নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত ঋণ প্রায় ১.৯৫ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা—অর্থাৎ প্রায় ৭৭ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৮৬ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৬২ শতাংশ এবং তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকা এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৮ শতাংশ।
এই মার্জারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের নিরাপত্তাকে। যাদের আমানত ২ লাখ টাকার কম, তারা একবারেই পুরো টাকা তুলে নিতে পারবেন। বড় অঙ্কের আমানত ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের অর্থ নগদ ফেরতের পরিবর্তে নতুন ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার প্রস্তাব থাকবে, যেহেতু এটি হবে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।
নতুন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার, ১২ হাজার কোটি আসবে আমানত বিমা তহবিল থেকে এবং ৩ হাজার কোটি টাকা আসবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এই অর্থের যোগান আসবে বাজেট, বৈদেশিক ঋণ এবং প্রয়োজনে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকে কোনো অর্থ দেবে না।
তবে এই মার্জার একটি ঝুঁকিও তৈরি করছে। পাঁচটি ব্যাংকের সম্মিলিত পেইড-আপ ক্যাপিটাল মাত্র ৫,৮১৯ কোটি টাকা, যা ক্ষতি সামলাতে একেবারেই অপ্রতুল। মার্জার পরিকল্পনা সফল না হলে তা ব্যাংকিং খাতের জন্য সিস্টেমিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক আমানত বিমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান আইনে ব্যাংক বন্ধ হলে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেওয়ার বিধান রয়েছে, তবে এখন ব্যাংক একীভূত হলেও টাকা ফেরতের সুযোগ রেখে নতুন সংশোধনী আনা হচ্ছে। প্রস্তাব রয়েছে, আমানত ফেরতের সীমা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্যোগ সফল করতে হলে প্রথমেই ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেছেন, “যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হচ্ছে তাদের অর্থ নিরাপদ, ততক্ষণ এই নতুন ব্যাংক গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।”
বিশ্বজুড়েই ব্যাংক একীভূতকরণ একটি প্রচলিত কৌশল। ভারত ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১০টিরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত করে সফলতা পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়াও ২০২১ সালে তিনটি ইসলামি ব্যাংক একীভূত করে গঠন করেছে ইন্দোনেশিয়া ইসলামী ব্যাংক, যা এখন আন্তর্জাতিক ইসলামি ফাইন্যান্স খাতেও প্রতিযোগিতা করছে। তবে পাকিস্তানে একীভূতকরণ কার্যকর হলেও দুর্বল তদারকি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।
বাংলাদেশের জন্য তাই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব, তবে রাজনৈতিক প্রভাব বা দুর্বল নীতিনির্ধারণ থাকলে এই উদ্যোগও ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি বহন করে।