বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হলে ১৫ আসন এনসিপির, আলোচনা চলছে
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১৬ নভেম্বর) : ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি তার শরিকদের ২৫টি আসন ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। ইতোমধ্যে শরিকদের ১২ জনকে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হলেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি দলটি। পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে থাকা ছাত্রদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে আসন সমঝোতা হলে তাদের আরও ১৫টি আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি।
দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে এ তথ্য।
এ নিয়ে বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে জোট গঠনের বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। জোট গঠন বা আসন সমঝোতার ব্যাপারটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে বিএনপি। তবে এই জোট হবে কি না, তার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দলগুলো।
জানা গেছে, জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করতে অনাগ্রহী এনসিপি।
ঢাকা-১০ আসন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে ছেড়ে দিতে পারে বলে বিএনপির মধ্যে আলোচনা আছে। সম্প্রতি ওই আসনে ভোটার হয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ।
এ ছাড়া ঢাকা-৯ ও ঢাকা-১১ আসন ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি। এ ছাড়া আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে ঢাকার একটি আসন ছাড় দিতে পারে বলেও রাজনীতিতে গুঞ্জন রয়েছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘জোট গঠনের ব্যাপারে আমরা আগের অবস্থানেই আছি। যারা বিচার ও সংস্কারকাজের ব্যাপারে আপসহীন থাকবে তাদের সঙ্গে আমরা আছি। যারা এসবের বিপক্ষে অবস্থান নেবে তাদের সঙ্গে আমরা নেই।’ তিনি বলেন, ‘এনসিপিকে রাজনীতির মাঠে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চাই। কারও ওপর নির্ভর করতে চাই না। সাধারণ মানুষের কাছে এনসিপিকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আমরা এককভাবে নির্বাচন করতে চাই। এনসিপি নতুন শক্তি হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভাব হবে।’
সূত্র জানায়, বিএনপির কাছে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের জমা দেওয়া প্রার্থী তালিকা বেশ বড় ছিল। প্রতিটি দল ও জোটের তালিকা ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জিতে আসার সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। বিশেষ করে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে শরিক দলগুলোর নেতাদের ভূমিকা, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে তাদের প্রয়োজনীয়তা- এ বিষয়গুলো প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা জোটের আসন এখনো চূড়ান্ত করিনি। সব দলকে হয়তো আমরা পর্যাপ্ত আসন দিতে পারব না। তবে কিছু দেওয়া হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি নিয়ে আরও পর্যালোচনা করছেন।’
শরিক দলের একাধিক নেতা বলছেন, বিএনপির ২৩৭ আসনে মনোনয়ন ঘোষণার পর প্রায় দুই সপ্তাহ গেলেও এখনো শরিকদের আসন চূড়ান্ত করা হয়নি। এতে শরিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপির আসন বণ্টনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে জোট নেতারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ এবার নিজ নিজ দলের প্রতীকে সবাইকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে।
দীর্ঘদিনের মিত্র ১২-দলীয় জোটকে এবার তিনটি আসনে ছাড় দেওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। এরা হলেন পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। এই তিনজনকে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। এসব আসনে বিএনপি কোনো প্রার্থী দেয়নি।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের পাঁচটি আসনে ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। ইতোমধ্যে মঞ্চের দুজন নেতাকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। এরা হলেন বগুড়া-১ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। এই দুই আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি বিএনপি।
এ ছাড়া বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হককে ঢাকা-১২ আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রবকে সংরক্ষিত নারী আসনে তাকে সংসদে নেওয়া হবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৮ থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা চলছে। আগামী দু-চার দিনের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠক হবে। সেখানে আসনের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, “ঢাকা-১২ আসনে আমাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে শুনেছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু এখনো জানানো হয়নি। আমি ঢাকা-১২ আসনের ভোটার। ৩০ বছর ধরে এই আসনে থাকি। ২০১৮ সালেও জোটের মিত্র হিসেবে জোনায়েদ সাকি এই আসনে ‘কোদাল’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিল। এবারও আমি ‘কোদাল’ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করব।”
সাইফুল হক বলেন, ‘শরিকদের সবার মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। আমাদের একেকটা দিন এক মাসের মতো। আসন নিয়ে দ্রুত ঝোঝাপড়া না হলে শরিকদের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব বাড়তে পারে। এতে ভবিষ্যত রাজনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে নড়াইল-২, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাকে ঢাকা-১৩ এবং গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরীকে ঢাকা-৭ এবং রাজবাড়ী-২ আসনে জোটের মিত্র হিসেবে এনডিএম মহাসচিব মোমিনুল আমিনকে ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। এদের ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও ববি হাজ্জাজকে সবুজ সংকেত দিয়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ঢাকা-১৩ আসনে প্রচার চালাচ্ছেন ববি হাজ্জাজ।
এ ছাড়া লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে একটি আসনে ছাড় দেওয়া হতে পারে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতা ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরা লিয়াজোঁ কমিটির নেতা নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমার একটি আসন কনফার্ম আছে। দু-এক দিনের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠক হবে।’
২০১৮ সালের নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) ৫টি আসন পেলেও এবার পাচ্ছে দুটি। চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক ও কুমিল্লা-৭ আসনে দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ। ইতোমধ্যে দুজনকেই সংকেত দিয়েছে বিএনপি।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (বিজেপি) দুটি আসনে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি ভাবছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ঢাকা-১৭ আসনে চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপিকে আরও একটি আসনে ছাড় দেওয়া হতে পারে।
বিএনপির কাছ থেকে গণঅধিকার পরিষদ দুটি আসন ছাড় পাচ্ছে। এরা হলেন পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও ঝিনাইদহ-২ আসনে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। দুজনই ইতোমধ্যে সবুজ সংকেত পেয়েছেন।
চারদলীয় জোটের মিত্র জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবার বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেই নির্বাচন করতে চাইছে। ইসলামপন্থি অন্য দলগুলো জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে গেলেও তারা যায়নি। দলটি ১২ জনের তালিকা জমা দিলেও পাঁচটি আসনে ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। সিলেট-৫ আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমির উবায়দুল্লাহ ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, নীলফামারী-১ আসনে মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, সুনামগঞ্জ-২ আসনে কেন্দ্রীয় নেতা শোয়ায়েব আহমদ, কিশোরগঞ্জ-১ আসনে মোখলেছুর রহমান চৌধুরীকে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এসব আসনেও বিএনপি কোনো প্রার্থী দেয়নি।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। জোটে যেতে হলে আমরা পাঁচটির বেশি আসন চাই। সন্তোষজনক আসন পেলেই আমরা জোটে যাব।’
