অপরিকল্পিত সেতুতে নদ-নদীর সর্বনাশ
নিজস্ব প্রতিবেদক (যশোর), এবিসি নিউজ, (২৮ সেপ্টেম্বর) : যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষসহ কয়েকটি নদ-নদী খননে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও প্রবাহ ফেরেনি। নদী রক্ষা কমিটি ও বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ, দখল ও দূষণের কারণে খনন প্রকল্পগুলো কার্যকর হয়নি। ভৈরব নদের ওপর নির্মিত সেতুগুলো নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। দখলদারদের তালিকা প্রকাশ হলেও উচ্ছেদে উদ্যোগ শিথিল হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
ভৈরব নদের ওপর দড়াটানাসহ তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দড়াটানা সেতুটিই প্রধান। সেতুটিতে দাঁড়ালে দেখা যায় নদীটি কচুরিপানায় ভরে গেছে, দেখে মনে হবে নদী নয় এটি একটি সরু খাল। সেতুর দুই পাশে নদীতীর দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। এসব স্থাপনার বর্জ্য পড়ে স্রোত ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে ভৈরব নদ। নদের পানি কুচকুচে কালো আর দুর্গন্ধময়।
শুধু ভৈরব নদেই না, জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ, হরিহর, কোদলা, ইছামতী, হাকর, বেতনা বা বেত্রবতী, মুক্তেশ্বরী, কাজলা, চিত্রা, শ্রী, টেকা, হরি, ভদ্রা ও আতাই এসব নদ-নদীও দখল, দূষণ ও অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণের কারণে অস্তিত্ব-সংকটে।
মৃতপ্রায় এসব নদ-নদীকে বাঁচাতে নানা সময়ে খননসহ নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু সেসব খুব বেশি কাজে আসেনি। বরং পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতায় নদ-নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য সেতু। আরও সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
দখলকারীদের তালিকা হলেও উচ্ছেদে ভাটা
২০২০ সালের ৩০ জুলাই জেলার নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের আংশিক তালিকা প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এই তালিকায় জেলার ৬৭৩ জন দখলদারের নাম ছিল। তালিকা অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। বরং ২০২২ সালে সংস্থাটির ওয়েবসাইট থেকে স্থাপনার তালিকা সরিয়ে নেওয়া হয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে তালিকায় যশোর সদর উপজেলায় ভৈরব দখল করে নির্মাণ করা রয়েছে দলীয় কার্যালয়, ক্লিনিক, মার্কেট, পুকুর, বিভিন্ন ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। দড়াটানা সেতু থেকে কাঠের পুল পর্যন্ত দুই তীরে ৮০০ মিটার এলাকা ৫০ জনের বেশি প্রভাবশালী দখলে রেখেছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ২০টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত নদের এই অংশের সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেনি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অথচ নদের ওই অংশ বাদ রেখে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পশ্চিমাংশের ৮৪টি স্থাপনা ও পূর্বাংশের সাড়ে তিন কিলোমিটারে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। পরে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।
বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলীয় কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, পুকুর, বিভিন্ন ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। আংশিক তালিকায় এই নদীর ওপর ৪১টি অবৈধ দখলদার রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরে নদীর অবৈধ দখলদারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠানো হয়, তাতে ১২৬ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করা হয়।
আংশিক তালিকায় মনিরামপুর উপজেলার হরিহর, মুক্তেশ্বরী, শ্রী ও হরি নদ-নদী দখল করেছেন ১৬২ জন; ঝিকরগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদের দুই পাশ দখল করে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন ৩০ জন; চৌগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদ দখল করেছেন ৮০ জন এবং শার্শা উপজেলার বেতনা নদী ও হাকর নদ দখল করেছেন ২২৪ জন। আর অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদ দখলের তালিকায় ৪৯ জনের নাম রয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ী, যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৫টি। এর মধ্যে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং বিআইডব্লিউটিএর সহযোগিতায় ২০২৪ সালের মে মাসে দুই ধাপে ৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ৩৬টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় নদের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে।
খননেও প্রবাহ ফেরেনি
চৌগাছার তাহেরপুর কপোতাক্ষের উৎসমুখ থেকে খুলনার রূপসা-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে রূপসা-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের বসুন্দিয়া পর্যন্ত ভৈরবের ৪১ কিলোমিটার প্রবহমান। আর বসুন্দিয়া থেকে সদর উপজেলার রূপদিয়া পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার ক্ষীণ ধারা প্রবহমান। সেখান থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার প্রবাহহীন। ২৭৯ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন হয়েছে। এ ছাড়া বসুন্দিয়া থেকে আফ্রাঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার ড্রেজিং করা হলেও প্রবাহ ফেরেনি।
এদিকে কপোতাক্ষে প্রাণ ফেরাতে ২০১১ সালে নদ খননের প্রকল্প হাতে নেয় পাউবো। ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৭ সালে শেষ হয়। যদিও খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি তখন। ২০২০ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে খননকাজ শুরু করে পাউবো। এতে ব্যয় হচ্ছে ৫৩১ কোটি টাকা। এতে মোট খরচ হয় ৮১৭ কোটি টাকা। নতুন প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৬৯ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে।
অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ
বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কপোতাক্ষ নদে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় ২১টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি সেতুর উচ্চতাই কম। অর্থাৎ নৌযান চলাচলের মতো উচ্চতা রেখে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়নি। একটি সেতু শুধু যথেষ্ট উচ্চতায় তৈরি করা হয়েছে। তবে সেটির সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে নদটিকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে।
ভৈরব নদের ওপর নির্মিত ৫২টি অপরিকল্পিত সেতু রয়েছে। সেতু নির্মাণ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য নদের দুই পাড় মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এতে নদী সংকুচিত হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ
ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে নদের দুই পাড়ের দখল বেড়েছে। নদী রক্ষায় সরকার নদীতট আইন করলেও তা প্রয়োগ করা হয় না।’
যশোরের কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অনিল বিশ্বাস বলেন, কপোতাক্ষ নদের দুই পাশে গভীর করে কাটা হলেও মাঝখানে ঠিকমতো খনন করা হয় না। আবার খননের মাটি নদেই ফেলা হচ্ছে। যেভাবে নদ খনন করা হচ্ছে, তাতে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না।’
এ বিষয়ে পাউবো যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার বলেন, ভদ্রা, হরি ও কপোতাক্ষ নদের খননকাজ শেষের পথে। ভৈরবের খননকাজ চলছে। খননকাজ শেষ হলে নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাবে।
যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানান, নদ-নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ একটি চলমান প্রক্রিয়া। নদ-নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ আবার শুরু করা হবে। সীমানা চিহ্নিত করার পর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হবে।