সাইফুজ্জামানের হাজার কোটি টাকা পাচারের স্বীকারোক্তি জাহাঙ্গীরের
চট্টগ্রাম ব্যুরো, এবিসি নিউজ, (২৬ সেপ্টেম্বর) : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তরধারী মো. জাহাঙ্গীর আলম ১৯৯৮ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে এবং পরবর্তীকালে এজিএম হিসেবে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের স্ত্রী রূকমীলা জামানের প্রতিষ্ঠান আরামিটে কর্মরত ছিলেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে দুদক উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিমের অভিযানে গ্রেপ্তার হন তিনি। এ সময় জাবেদের ইস্যু করা ১১টি চেক দিয়ে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে ১ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংক থেকে ৩৬ লাখ টাকা এবং মেঘনা ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা তোলা হয়।
গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) আরামিট পিএলসির এজিএম জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২ এর আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়েছেন। তার প্রদত্ত জবানবন্দিতে সাইফুজ্জামান ও তাঁর সহযোগী আব্দুল আজিজ, উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামান সিন্ডিকেট কর্তৃক হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
চট্টগ্রাম আদালত ও দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া জাবেদের কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলমের সেই জবানবন্দিতে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিনব কৌশলের বিবরণ মিলেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করার পর আরামিট পিএলসির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ২ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। এর আগে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর নানা অনিয়মের ২৩ বস্তা ডকুমেন্ট উদ্ধার হয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় সাইফুজ্জামানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা আরামিট গ্রুপের এজিএম উৎপল পাল এবং আবদুল আজিজকে গ্রেপ্তার করা হয়। যত দিন যাচ্ছে, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের বিভিন্ন রেকর্ডপত্র বেরিয়ে আসছে। এবার জবানবন্দিতেও অনেকখানি সত্যতা মিলেছে।
জাহাঙ্গীরের জবানবন্দিতে যা পাওয়া গেছে
আরামিট পিএলসি হতে দুদকের উদ্ধারকৃত ১ কোটি ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৩০ টাকার ব্যাখ্যা :
জাহাঙ্গীরের কর্মচারী শাহ আলমের নিকট থেকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর আরামিট পিএলসির অফিস হতে উদ্ধারকৃত ৭৭ লাখ ৬ হাজার ৭৩০ টাকার মধ্যে ৬৭ লাখ টাকা আরামিট পিএলসির সিইও কনক কান্তি সেনের নির্দেশে ব্যাংক থেকে উঠিয়ে আমার (জাহাঙ্গীরের) অফিস কক্ষে রক্ষিত অফিসের ভল্টে শাহ আলমের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে, চেকে ‘Company & Legal Purpose’ উল্লেখ করে ১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয় বলে জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে।
ক্লাসিক ট্রেডিংসহ ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার :
জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আরামিট গ্রুপের কর্মচারী জসিম উদ্দিনকে প্রগ্রেসিভ ট্রেডিংয়ের মালিক, মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরীকে রিলায়েবল ট্রেডিংয়ের মালিক, মিছবাহুল আলমকে মডেল ট্রেডিংয়ের মালিক, ফরমান উল্লাহ চৌধুরীকে ভিশন ট্রেডিংয়ের মালিক, কর্মচারী সৈয়দ কামরুজ্জামানের আত্মীয় নুরুল ইসলামকে ক্রিসেন্ট ট্রেডার্সের মালিক এবং শেখ ফোরকানকে ইমনেন্ট ট্রেডিংয়ের মালিক হিসেবে সাজিয়ে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স তৈরি করা হয়। এসব ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে ইউসিবিএল-এর বিভিন্ন শাখায় ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। পরবর্তীতে এসব হিসাবের মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করা হয় এবং তা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে নগদে অর্থ উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়। এ কাজে সরাসরি সহযোগিতা করেন আরামিট পিএলসির সিওও সৈয়দ কামরুজ্জামান, এজিএম আব্দুল আজিজ এবং এজিএম উৎপল পাল।
২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি জাহাঙ্গীর আলমকে আমদানিকারক ব্যবসায়ী এবং তাঁর স্ত্রীকে নমিনি দেখিয়ে ইউসিবিএল-এর স্টেশন রোড শাখায় ক্ল্যাসিক ট্রেডিং নামে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। এই হিসাব খোলার সময় তাঁর স্বাক্ষর জোরপূর্বক নেওয়া হয়। হিসাব খোলার পর ব্যাংক থেকে ইস্যুকৃত পাঁচ থেকে ছয়টি চেক বইয়ে (প্রতিটি ৫০ পাতার) মোট ২৫০-৩০০টি খালি বা ব্ল্যাংক চেকের পাতায় তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হয় এবং এসব চেক বই পরবর্তীতে আব্দুল আজিজ নিজের হেফাজতে নিয়ে যান।
এরপর আরামিট গ্রুপের বিভিন্ন কর্মচারীদের নামে খোলা ভুয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে আরামিট সিমেন্ট, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম এবং আরামিট স্টিল পাইপসের নামে ঋণ গ্রহণ করা হয়। এসব ঋণের অর্থ জাহাঙ্গীর আলমের ক্ল্যাসিক ট্রেডিং হিসাবের মাধ্যমে স্থানান্তর করে পরে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী রুকমীলা জামানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে পাঠানো হয়। পরে আরামিট গ্রুপের কর্মচারীরা নগদে টাকা উত্তোলন করেন। এদের মধ্যে ইয়াসিনুর রহমান, যিনি আরামিট সিমেন্টের পিয়ন হিসেবে কর্মরত, এবং মো. হোসাইন চৌধুরী, যিনি আরামিট সিমেন্টের অফিসার, ছাড়াও আরও কয়েকজন কর্মচারী নগদে অর্থ উত্তোলনের কাজে জড়িত ছিলেন।
২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ক্ল্যাসিক ট্রেডিং নামীয় হিসাবটিতে মোট ৬৫১ কোটি ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৫৭৯ টাকা জমা এবং উত্তোলন করা হয়।
একই পদ্ধতিতে মোহাম্মদ জাহিদের নামে রেডিয়াস ট্রেডিং, মো. ফরিদ উদ্দিনের নামে লুসেন্ট ট্রেডিং এবং আব্দুল আজিজের নামে ইম্পিরিয়াল ট্রেডিংয়ের ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করা হয়। এসব হিসাবের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার লেনদেন করা হয় এবং পরে নগদে অর্থ উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন জাহাঙ্গীর আলম।
ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার :
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট সিমেন্টের এমডি রুকমীলা জামানের নামে ইসলামী ব্যাংক জুবলী রোড শাখা হতে ৫০০ কোটি টাকার একটি বাই মুরাবাহা ঋণ নেওয়া হয়। যেখানে জাহাঙ্গীরকে “ক্লাসিক ট্রেডিং” এর নামে নামসর্বস্ব হিসাব খোলার মৌখিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়ামের জিএম সৈয়দ কামরুজ্জামান আরামিট পিএলসির আব্দুল আজিজকে ভুয়া ব্যবসায়ী দেখিয়ে ইমপেরিয়াল ট্রেডিং এবং জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন ক্লাসিক ট্রেডিং-এর হিসাব খোলেন। ওই হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫১ কোটি টাকা লেনদেন করা হয়, যার মধ্যে প্রায় ২৫৫ কোটি টাকার লেনদেন করে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর কর্মচারীরা। পরবর্তীতে হিসাব সচল হবার পর আরামিট সিমেন্টের অনুকূলে ইসলামী ব্যাংক জুবলী রোড হতে বরাদ্দকৃত লোনের টাকাসহ অন্যান্য বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে লোনের টাকা জাহাঙ্গীরের হিসাবে জমা করা হয়। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষর করা খালি চেকের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নগদে উত্তোলন করে আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়ামসহ আরামিট গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরিত হয়েছিল। বর্তমানে দুদকের দায়ের করা ৬টি মামলার আসামি হিসাবে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠান :
মডেল ট্রেডিংয়ের মালিক মিছবাহুল আলম, ক্লাসিক ট্রেডিংয়ের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, রেডিয়াস ট্রেডিং-এর মালিক মোহাম্মদ জাহিদ, লুসেন্ট ট্রেডিংয়ের মালিক মো. ফরিদ উদ্দিন, ইমিনেন্ট ট্রেডিংয়ের মালিক শেখ ফোরকান, প্রগ্রেসিভ ট্রেডিংয়ের মালিক জসিম উদ্দিন, ভিশন ট্রেডিংয়ের মালিক ফরমান উল্লাহ চৌধুরী, রিলায়েবল ট্রেডিংয়ের মালিক হোসেন চৌধুরী, ক্রিসেন্ট ট্রেডার্সের মালিক নুরুল ইসলাম এবং ইমপেরিয়াল ট্রেডিংয়ের মালিক আব্দুল আজিজের নামে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেন।
ভুয়া অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত লোনের তথ্য :
ইউসিবি ব্যাংকের ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখায় মডেল ট্রেডিং, ইমিনেন্ট ট্রেডিং, প্রগ্রেসিভ ট্রেডিং, ভিশন ট্রেডিং, রিলায়েবল ট্রেডিং ও ক্রিসেন্ট ট্রেডার্সের নামে হিসাব খুলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে আনুমানিক ১২৫ কোটি টাকা টাইম (ওয়ার্কিং ক্যাপিট্যাল) বাবদ লোন অনুমোদন করে ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হস্তান্তর করে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মুদ্রা পাচার প্রক্রিয়া :
ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন করিয়ে এবং প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের নিকট থেকে ঘুষ গ্রহণ বাবদ অর্থ পরবর্তীতে নগদ চেকের মাধ্যমে কোম্পানির বাহকের মাধ্যমে নগদে উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এখানে সাইফুজ্জামানের পক্ষে এজিএম ও পিএস আব্দুল আজিজ এবং এজিএম উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামান কাজ করেছেন। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দ্বারা সাইফুজ্জামান চৌধুরী বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন যা দেখাশোনা করতো এজিএম ও পিএস আব্দুল আজিজ এবং এজিএম উৎপল পাল।
ভিশন ট্রেডিং হতে ৪ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ক্ল্যাসিকে স্থানান্তর :
গ্রাহক ভিশন ট্রেডিংয়ের নামীয় ঋণের ওই টাকা ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ে স্থানান্তরের পর জাহাঙ্গীরের পূর্বে থেকে স্বাক্ষর নিয়ে রাখা চেক দ্বারা অর্থ স্থানান্তর ও উত্তোলন করা হয় বলে জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।