৬০ বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ, (২৬ সেপ্টেম্বর) : প্রায় ৬০ বছর পর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিলেন সিরিয়ার কোনো নেতা। এ নেতা আর কেউ নন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারা। তাঁর এ যাত্রা এক অপ্রত্যাশিত মাইলফলক। একসময় আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নামে পরিচিত শারা ছিলেন সিরিয়ার আল-কায়েদা শাখার নেতা। তখন তাঁর মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার হেঁকেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর এখন সেই শারা স্যুট-টাই পরে জেট বিমানে নিউইয়র্ক সিটিতে এসেছেন। দ্য টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, সিরীয় প্রবাসী ও সাবেক সিআইএ পরিচালক জেনারেল ডেভিড পেট্রাইউসের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা সম্মানিত হচ্ছেন। এ যেন এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘে শারার অভিষেক তাঁর সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে আরও শক্তিশালী করবে। কিন্তু সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যারা এখন শারাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তাদের উচিত একটি বিভক্ত দেশে ক্ষমতা আরোপের জন্য উৎসাহিত না করে বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া।

মাত্র ১০ মাস আগে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার সিরিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু ২০২৪ সালের শেষের দিকে শারার হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বে আক্রমণ শুরু হলে সিরীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখল করেন এবং আসাদ মস্কোতে পালিয়ে যান। হঠাৎ করেই শারা সিরিয়ার কার্যত প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠেন, যা আসাদ পরিবারের অর্ধশতাব্দীর শাসনের অবসান ঘটায়।

শারার নতুন সরকার বিদেশে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে। বিভিন্ন দেশ দামেস্কে মন্ত্রী পাঠিয়ে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করেছে। প্রথমদিকে ট্রাম্প প্রশাসন শারার প্রতি কিছুটা শীতল ছিল, কারণ ইসরায়েলি সরকার নতুন সিরীয় নেতা সম্পর্কে সংশয়ে ছিল। কিন্তু মে মাসে সৌদি আরবের যুবরাজ ট্রাম্প ও শারার মধ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। বৈঠকে ট্রাম্প এ সিরীয় নেতাকে ‘একজন শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করেন। এর পর থেকে ট্রাম্প প্রশাসন শারার সরকারের একজন ‘উৎসাহী’ সমর্থকে পরিণত হয়।

ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রথম কয়েক মাসে শারা আন্তর্জাতিক বৈধতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বেশ কিছু দেশে সফর করেছেন এবং দামেস্কে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু সিরীয় জনগণের উদ্দেশে খুব কমই ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর এই কৌশল বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে করা হয়। শারা আসাদ-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছেন। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন, যা সিরিয়ার পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।

কিন্তু দেশের ভেতরে শারার সরকারের স্থিতিশীলতা ও বৈধতা এখনো অনিশ্চিত। তাঁর সরকার তাদের কর্তৃত্বকে সুসংহত করেছে, কিন্তু তা পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উপায়ে নয়। জানুয়ারিতে বিদ্রোহী কমান্ডাররা শারাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেন। এ সময় তিনি সশস্ত্র দলগুলোকে ভেঙে দেওয়ারও ঘোষণা দেন। পরের মাসে তাঁর সরকার একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে, কিন্তু এটি ছিল মাত্র দেড় দিনের সংক্ষিপ্ত একটি সম্মেলন, যেখানে কোনো গভীর আলোচনা হয়নি।

এরপর মার্চ মাসে তাঁর সরকার পাঁচ বছরের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সংবিধান গ্রহণ করে। ইসলামি আইনকে প্রধান আইনি ভিত্তি করে তৈরি এই সংবিধানে শারাকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কুর্দি সম্প্রদায়ের লোকজন দাবি করেছেন, এই সংবিধানে নতুন সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মতামত উপেক্ষা করেছে। এমনকি তাঁদের সংলাপেও অংশ নিতে দেয়নি। তাঁদের অভিযোগ, এই সাংবিধানিক কাঠামো সিরিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে না এবং এটি আগের শাসনের নীতি বহাল রাখার কৌশল।

সিরিয়ার সরকার এখন সংসদীয় নির্বাচনের আয়োজন করছে। কিন্তু এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। কারণ ২১০ আসনের এই সংসদের এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি নিয়োগ দেবেন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারা।

শারা যদিও বহু বছর আগে আল-কায়েদা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, তবু তিনি সুন্নি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। এদিকে সিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সুন্নি আরব হলেও আলাউইত, খ্রিষ্টান, দ্রুজ, কুর্দিসহ অসংখ্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। এই সংখ্যালঘুদের মধ্যে যাঁরা শারার সুন্নি আরব ধারণার সঙ্গে একমত নন, তাঁরা মনে করেন, নতুন সিরিয়ায় তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাঁরা বলেন, প্রকৃত ক্ষমতা এখনো শারার সহযোগী ও সাবেক তাহরির আল-শাম সদস্যদের একটি ছোট বৃত্তের হাতেই সীমাবদ্ধ।

এ ছাড়া সিরিয়া এখনো আঞ্চলিকভাবে বিভক্ত। সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর মধ্যে দামেস্কের সাবেক বিরোধী দলগুলোর ওপর সীমিত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আবার বাকি অংশগুলোর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে গিয়ে শারার প্রশাসন সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে বলেও জানা গেছে। যেমন, গত মার্চে সরকারি বাহিনী সিরিয়ার উপকূলে একটি বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে সংখ্যালঘু আলাউইত সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৫০০ মানুষকে হত্যা করে।

এরপর জুলাই মাসে যখন সরকারি বাহিনী ও তাদের সহযোগী প্যারামিলিটারিরা দ্রুজ সংখ্যাগরিষ্ঠ সুওয়েদা প্রদেশ দখলের চেষ্টা করে, তখন ইসরায়েল সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে তাদের পিছু হঠতে বাধ্য করে। তবে সুওয়েদা এখনো শারার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং সেখানকার স্থানীয় নেতারা এখন স্বায়ত্তশাসন দাবি করছেন। অন্যদিকে, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া এখনো কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই অঞ্চলকে সিরিয়ার অন্য অংশের সঙ্গে একত্র করার জন্য মার্চে করা একটি চুক্তিও থমকে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত টম ব্যারাক প্রকাশ্যে শারার পক্ষ নিয়ে বলেছেন, ‘শারার বিকল্প কোনো পরিকল্পনা নেই।’ তবে বিশ্লেষকদের মতে, ব্যারাকের সমর্থন শারার সরকারকে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করতে উৎসাহিত করছে।

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে সিরিয়ার ঐক্য, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পুনর্গঠনে সমর্থন চেয়েছেন আহমদ আল-শারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাঁর আহ্বান ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সিরিয়া এখনো বিভক্ত, এর বৈধতা নিয়েও এখনো প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া একক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়াকে সমর্থন দিলে নতুন করে আবারও সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ