জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর সরকার নজরদারি বাড়াচ্ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসি নিউজ, (২২ সেপ্টেম্বর) : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি জোরদার করছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসীরা পুনরায় অপরাধে জড়ালে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের গতিবিধি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ সদর দপ্তর, বিজিবি, কোস্টগার্ড, এনএসআই, ডিজিএফআই ও এসবিকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সভাসূত্র বলছে, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বলা হয়েছে মুজিববাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রম যেকোনোভাবে বন্ধ করতে হবে এবং তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আনতে হবে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ ও র্যাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে নিষিদ্ধ দল বা সংগঠন ও ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা যেন জামিন না পায় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার
বৈঠকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে মসজিদ, মন্দিরসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য প্রচার অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ সংগঠন ও ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের হোতাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নজরদারিতে হিযবুত তাহরীর
জামিনে মুক্ত হিযবুত তাহরীরের চিহ্নিত সদস্যদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠকে। এজন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ সদর দপ্তর ও বিজিবির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় তিন গোয়েন্দা সংস্থাকে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিযবুত তাহরীরের প্রচারণা মোকাবিলায় পাল্টা কৌশল নিতে বলা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে– ইসলামী বক্তাদের মাধ্যমে কোরআন-হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা প্রচার করা। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ওয়াজ মাহফিল ও জুমার খুতবায় নিয়মিতভাবে এ ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। একইসঙ্গে অনলাইনে সঠিক তথ্যভিত্তিক পাল্টা বক্তব্য (কাউন্টার-ন্যারেটিভ) প্রচার চালানো হবে।
অস্ত্রের লাইসেন্সে কড়াকড়ি
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও অনুমোদিত সিকিউরিটি সার্ভিস ছাড়া অন্য কাউকে অস্ত্রের অনুমতি দেওয়া হবে না বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চাঁদাবাজদের তালিকা
সভায় সারা দেশের চাঁদাবাজদের শনাক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ তালিকাভুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপরতা জোরদার ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করে কোনো ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি যেন দেশত্যাগ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিজিএফআইসহ সব গোয়েন্দা সংস্থাকে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারি
বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) ক্যাম্প এলাকায় বিশেষ নজরদারি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠক থেকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও গুজবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের মতে, নির্বাচনের সময় জামিনে থাকা সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। তাই সরকারের নজরদারি জোরদার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর কঠোর নজরদারি করছে সরকার, ব্যাপারটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বাইরে থাকা সবসময়ই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। তাছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে যে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের দোসরদের অর্থ ও এজেন্টের অভাব নেই। তারা সন্ত্রাসীদের কাজে লাগিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও ধ্বংসাত্মক কাজ করে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সর্বদাই সচেষ্ট থাকবে। আর জাতীয় নির্বাচনের সময় সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো আরও বেশি নাজুক। তাই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর শুধু কড়া নজর রাখলেই চলবে না, তাদের জরুরি ভিত্তিতে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করতে হবে। এজন্য সব গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে কাজ করতে হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা হলো– জামিনে মুক্ত অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তির পরপরই আবার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণে নির্বাচনের আগে তাদের কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। সরকার যে নজরদারি জোরদার করছে, এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তিনি আরও বলেন, কেবল নজরদারি নয়, তাদের দ্বারা অপরাধ কর্মকাণ্ড রোধে আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে। জামিনের শর্ত ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে জামিন বাতিল করে পুনরায় কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। একইসঙ্গে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা গেলে সন্ত্রাসীরা দীর্ঘদিন মামলা ঝুলিয়ে রেখে অপরাধ চালিয়ে যেতে পারবে না। এক্ষেত্রে প্রসিকিউশন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, সরকার নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অবশ্যই তাদের নজরদারিতে রাখতে পারে। নজরদারি বৃদ্ধি করার নানা কারণ থাকতে পারে। নজরদারি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের স্বাধীনতা রয়েছে। যেহেতু নির্বাচনে সব সাধু লোক অংশগ্রহণ করে না, সেহেতু নজরদারি রাখতে দোষ নেই।
অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্ত রয়েছেন, এটা নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামিন মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। একজন মানুষ যতক্ষণ না অপরাধী প্রমাণিত হবে ততক্ষণ তাকে আটকে রাখার অধিকার নেই।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে, এটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। কারণ নির্বাচনের সময় এ ধরনের সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হলে ভোটকেন্দ্র দখল, ভীতি সৃষ্টি কিংবা ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তিনি আরও বলেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এসব সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট নয়। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা, কমিউনিটি পুলিশিং সক্রিয় করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণে বাধ্য করাই হবে টেকসই সমাধান। আমাদের দেশে অতীতে দেখা গেছে, কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনী সুবিধা নেওয়ার জন্য সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে কেবল নজরদারি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না।
রাশেদা রওনক মনে করেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচনের সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দমনকে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে যেন তারা ভীত না হয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তথ্য সরাসরি কর্তৃপক্ষকে জানায়। তখনই সরকার যে নজরদারি বাড়াচ্ছে, সেটি কার্যকর রূপ পাবে।