বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ইসলামী ব্যাংক!
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১০ ডিসেম্বর) : ইসলামী ব্যাংক এখন বিশেষ একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে মুনাফা অর্জন করায় শক্তিশালী আর্থিক বুনিয়াদিভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি। সে কারণেই তুলনামূলক বিবেচনায় সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক অবস্থার অবনমনের পরও ৫ ইসলামী ব্যাংকের ‘ভাগ্য’ বরণ করতে হয়নি ব্যাংকটিকে।
৫টি ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক) আর্থিক অবস্থাকে অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনা করে ৫ আগস্ট-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী এই ব্যাংকগুলোকে এখন একটি ব্যাংকের পরিচিতির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তবে বিগত সরকারের সময় ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক বিচারে খারাপ হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যাংকটিকে নবগঠিত সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের আওতাভুক্ত করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এখন বলছেন, ইসলামী ব্যাংক এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরপরই একটি বিশেষ গোষ্ঠী সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। দীর্ঘদিন ব্যাংকটি থেকে দূরে সরে থাকলেও গত প্রায় দেড় বছরে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রায় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আবার ব্যাংকটিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইবনে সিনা ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ নামে-বেনামে আরও বেশ কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামী ব্যাংক সব সময়ই দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকগুলোর একটি ছিল। ইসলামী ব্যাংক ছিল দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক। বিগত সরকারের সময়ও ব্যাংকটি রেকর্ড মুনাফা করেছে। তবে অল্পবিস্তর অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে। তার পরও গত বেশ কয়েক বছর ধরে ভালো ব্যবসা করায় ব্যাংকটি অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় এগিয়ে ছিল।
গত ৫ বছরে ব্যাংকটির মুনাফা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিবছরই সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করে আসছে ব্যাংকটি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ব্যাংকটি সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের তালিকা থেকে ছিটকে পড়ে। ২০২০ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। ২০২২ শেষে ব্যাংকটির মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি ২ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের রেকর্ড ভঙ্গ করে। এ সময় ব্যাংকটির মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নিট মুনাফা অনেক কমে যায়। ফলে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিতে পারেনি ব্যাংকটি।
বর্তমান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, এখন আবার ইসলামী ব্যাংক পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকটি কতটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরীক্ষা করানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বলে আসছেন, ইসলামী ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সূচকের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হচ্ছে যে, ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। এই ব্যাংকটির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে, এখনো আসছে। দেশের ধর্মপ্রাণ আমানতকারীরা এতকিছুর পরও তাদের আমানত তুলে নেননি। এসব কারণে ব্যাংকটি এখনো চলমান রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছে কি না, সেই বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরীক্ষা করা হলে বোঝা যাবে ব্যাংকটি কতটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
এদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ একাধিক নেতা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন, ৫ আগস্টের পর ইসলামী ব্যাংকগুলো একটি রাজনৈতিক দল দখল করে নিয়েছে।
রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আমি সেই রাজনৈতিক দলটিকে বলতে চাই, খুব নীরবে আপনারা সব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। শেখ হাসিনার ব্যাংক আত্মসাৎ ও ৫ আগস্টের পর আপনাদের ঘটনাও জনগণ দেখেছে।’ তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে যারা ব্যাংক লুট করেছে, ব্যাংক আত্মসাৎ করেছে, তাদের উত্তরসূরি হিসেবে ৫ আগস্টের পর আমরা কি ব্যাংক আত্মসাৎ হতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি, একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা কীভাবে ইসলামী ব্যাংক গ্রাস করে নিল।’
রিজভী বলেন, ‘আমরা তো প্রথমেই দেখলাম ৫ আগস্টের পরদিনই ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয় একটি গোষ্ঠী। এটি কি জনগণ দেখেনি? এটা তো দেখেছে জনগণ।’
এদিকে সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচালক মো. আবদুল জলিল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ এবং ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে কথোপকথনের কিছু অংশ ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি সামনে আসার পর রাজনৈতিক মহল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া— সব জায়গায় নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই বিতর্কের পর অবশ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত করা হবে না।
উল্লেখ্য, ভিডিও ফাঁসের দাবির পরই আবারও সামনে এসেছে ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য যোগাযোগ নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক। গত ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্পষ্টভাবে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামের কোনো সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক সম্পর্ক নেই।’ তবে নতুন করে কথোপকথন ফাঁসের অভিযোগ উঠায় বিষয়টি এখন জনমনে প্রশ্ন তুলেছে।
এ বিষয়ে জানতে মো. আবদুল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে অপর একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমিও বিষয়টি সম্পর্কে শুনেছি। তবে আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
মনোয়ারুল হক/
