পুলিশের অসহযোগিতায় বোবা মাদকের ২৯২ ওয়াকিটকি : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসি নিউজ, (১১ অক্টোবর) : সারা দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তাদের হাতে থাকা ২৯২টি ওয়াকিটকি দীর্ঘদিন ধরে নেটওয়ার্কহীন পড়ে রয়েছে। অথচ অচল এসব যন্ত্রের দেখভাল করতে অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে মোট ৭২ জন অপারেটর নিয়োগ দিয়েছে। প্রায় এক দশক এ যন্ত্রগুলো ব্যবহারযোগ্য না হলেও অপারেটররা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। কবে নাগাদ এই ওয়াকিটকি সচল হবে, তা কেউই জানে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের টাওয়ারে রিপিটার ও অ্যানটেনা বসাতে না দেওয়ায় ওয়াকিটকিগুলো কার্যত বোবা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে চিঠি চালাচালি ও একাধিক বৈঠক হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযান কিংবা নজরদারির সময় নিরাপদ যোগাযোগ-ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা নিরাপত্তা ও সমন্বয়ে বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, প্রায় প্রতিটি সমন্বয় সভায় কর্মকর্তারা ওয়াকিটকির অচলাবস্থার বিষয়টি তোলেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। দীর্ঘদিনেও এ সংকটের সমাধান না হওয়ায় মাদকবিরোধী অভিযানে অনেক ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে, ৭২ জন অপারেটরকে মূল দায়িত্বের বাইরে নানা কাজে লাগানো হচ্ছে। জেলা কার্যালয়ে যুক্ত অপারেটরেরা করণিকের কাজ করছেন। কেউ কেউ আদালতে মাদকের প্রসিকিউটরদের সহযোগিতা করছেন। কাউকে আবার মাঠপর্যায়ে মাদকবিরোধী অভিযানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. হাসান মারুফ গত শনিবার বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরই ওয়াকিটকি সচল করার উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকায় কার্যক্রম চালুর পাশাপাশি সারা দেশে নেটওয়ার্ক চালু করতে একটি ছোট কমিটি গঠন করেছি। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে।’
তবে অধিদপ্তরের ভেতরের অনেক কর্মকর্তা বলছেন, মূলত পুলিশ টেলিকমের সহযোগিতা না থাকায় সমস্যা জট পাকিয়ে রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ওয়াকিটকির জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) থেকে ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এরপর অধিদপ্তর রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, পাবনা, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় পুলিশের টাওয়ারে ডিএইচএফ রিপিটার বসানোর অনুমতি চায়। পুলিশ শর্ত সাপেক্ষে অনুমতিও দেয়। কিন্তু সেই অনুমতির প্রায় এক দশক পরও জেলা পুলিশের টাওয়ারের রিপিটার বসানোর জন্য মাদক অধিদপ্তরকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করে না পুলিশের টেলিকম বিভাগ। ঠিক কোন কারণে এমন অসহযোগিতা, তা অধিদপ্তর জানে না বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উত্তরাঞ্চলের এক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক (ডিডি) বলেন, ‘পুলিশ অনেক সংস্থার রিপিটার বসাতে দিয়েছে। কিন্তু মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের ক্ষেত্রে দেয়নি। কয়েকটি জেলায় টাওয়ারের একদম নিচে বসানোর অনুমতি পাওয়া গেলেও সেখানে ফ্রিকোয়েন্সি না মেলায় কোনো কাজ হয় না।’
টাওয়ার ও ফ্রিকোয়েন্সি সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মাদক অধিদপ্তরের ডিজি হাসান মারুফও। তিনি বলেন, ‘টাওয়ার ও ফ্রিকোয়েন্সির সমস্যা এখনো আছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি, যেন দেশব্যাপী ওয়াকিটকি সচল করা যায়।’
অন্যদিকে পুরো বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে দাপ্তরিক জটিলতা বলেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। পুলিশ টেলিকমের অতিরিক্ত আইজি মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘এটি পুরোপুরি দাপ্তরিক বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ আছে। বিস্তারিত আলোচনা করেই সমাধান বের করতে হবে।’
অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ তথ্য বলছে, প্রথম দিকে কয়েকটি করে ওয়াকিটকি ব্যবহার করার কথা থাকলেও ২০১৮-১৯ সালে মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের জন্য সর্বমোট ২৯২টি ওয়াকিটকি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ যন্ত্র শুরু থেকেই অচল। ঢাকার এক সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অভিযান পরিচালনার সময় ফোর্স কম, গাড়ি কম—এ অবস্থায় একমাত্র আশা-ভরসা ছিল ওয়াকিটকির ওপর। সেটা এখনো অকেজো। জরুরি মুহূর্তে যোগাযোগ করার কোনো উপায় থাকে না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পুলিশ টেলিকম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে দীর্ঘদিন ধরে রিপিটার বসানোর ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করায় নিজেদের জন্য ঢাকা, রাজশাহী ও টেকনাফে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি টাওয়ার স্থাপন করে মাদক অধিদপ্তর; কিন্তু সেগুলো এখনো নেটওয়ার্কিংয়ের আওতায় আনা হয়নি।
অভিযানগুলোতে তদারকির দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওয়াকিটকি না থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। কখনো অপরিচিত প্ল্যাটফর্মেও যোগাযোগ করতে হয়, যা নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়ায়। জরুরি মুহূর্তে সহকর্মীদের ডাকার সুযোগও হচ্ছে না।’
অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, পুলিশের একজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পরিচালক (অপারেশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পুলিশেরই কর্মকর্তা হওয়ায় এই টানাপোড়েন দূর করতে ব্যর্থতার দায় তাঁর ওপরও বর্তায়।