আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের আহ্বান
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ, (২ অক্টোবর) : মিয়ানমারে চলমান গণহত্যা ঠেকাতে এবং নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ আহ্বান জানায় তারা। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
উইমেন্স পিস নেটওয়ার্ক-মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক রোহিঙ্গা নারী অধিকারকর্মী ওয়াই ওয়াই নু সভায় উপস্থিত বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশে বলেন, ‘মিয়ানমারের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হলেও, এই মুহূর্ত এল অনেক দেরিতে।’
ওয়াই ওয়াই নু জানান, রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘুরা বহু দশক ধরে বাস্তুচ্যুত, নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার গণহত্যার শিকার হওয়ার স্বীকৃতি মিললেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ওয়াই ওয়াই নুর ভাষায়, ‘আজই সেই চক্র শেষ হওয়া দরকার।’
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি’ হিসেবে বিবেচনা করছে, যদিও তাদের পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেখানেই বসবাস করছে। ১৯৮২ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া বন্ধ। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার পর সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলে ভয়াবহ দমন অভিযান চালায়। অন্তত ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা সে সময় বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণধর্ষণ, হত্যা আর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক মহল, এমনকি জাতিসংঘও একে জাতিগত নিধন ও গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে।
এরপর, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী। আন্দোলন দমনে সেনারা নির্মম সহিংসতা চালায়। এতে সারা দেশে গণতন্ত্রকামী গেরিলা যোদ্ধা আর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যও রয়েছে, যেখানে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে বন্দী অবস্থায় আছে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালিয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। চলতি বছর রাখাইনে জান্তাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই নতুন করে শুরু হওয়ার পর আরও ১ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
আরাকান আর্মি এখন রাখাইন রাজ্যের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে রোহিঙ্গাদের অবস্থার উন্নত হয়নি। তারা এখনো বৈষম্য, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, অবাধে চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা, সীমিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা আর গ্রেপ্তারের ভয় নিয়ে বেঁচে আছে। গ্রান্ডি বলেন, ‘তাদের জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়, জোর করে যুদ্ধে টেনে নেওয়া হয়। প্রতিদিন তারা বর্ণবৈষম্য আর ভয়ের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে।’
জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপ জানান, রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান এখনো দৃশ্যমান নয়। কোনো অস্ত্রবিরতি, শান্তির রোডম্যাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার পথ নেই।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, এ নির্বাচন জনগণের মতামত প্রতিফলিত করবে না এবং টেকসই শান্তির ভিত্তি গড়ে তুলবে না। নির্বাচন হবে সেনাদের নিয়ন্ত্রণে, রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব হারানোর কারণে ভোট দিতে পারবে না, আর রাখাইনের রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আরাকান ইয়ুথ পিস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা রফিক হোসন বলেন, ‘দশকের পর দশক নিপীড়নের শিকার হলেও আমাদের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা হলো শান্তি ও নিরাপত্তায় আমাদের পূর্বপুরুষের ভূমি মিয়ানমারে বসবাস করা।’ তবে তিনি জানান, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও চাপ ছাড়া তা সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা এলাকায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ অঞ্চল তৈরির আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা মঊং সাইয়েদ্দুল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আর রাখাইনে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ছাড়া স্থায়ী শান্তি আসবে না। তিনি বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ক্ষমতায়ন করতে জাতিসংঘকে সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে।’
সভা পরিচালনা করেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি আনালেনা বেয়ারবক। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘আজ কেবল একটি শুরু, আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে।’ তিনি কর্মভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।