ফুঁসে উঠেছেন শেয়ারহোল্ডাররা, গভর্নরের পদত্যাগ দাবি
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (৭ নভেম্বর) : একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য ‘শূন্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন ঘোষণায় এসব ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা মোট ৪৭০ কোটি শেয়ারের ভাগ্য অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শরিয়াহভিত্তিক এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন স্থগিত ঘোষণা করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) গতকাল সকালে লেনদেন শুরুর আগেই নিজ নিজ ওয়েবসাইটে এ সিদ্ধান্তের কথা বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দেয়। ফলে গতকাল থেকে শেয়ারবাজারে পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তারা বলেন, আগামী শনিবার রাত ১২টার মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করছি। কারণ তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা না করে মার্জার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছেন। তাই উল্লিখিত সময়ের মধ্যে (শনিবার) তারা পদত্যাগ না করলে আগামী মঙ্গলবার বেলা ২টায় ওই পাঁচ ব্যাংকের বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাওসহ কঠোর কর্মসূচি পালন করা হবে।
গতকাল বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টরস ইউনিটি কাউন্সিলের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের কষ্টে অর্জিত বিনিয়োগকে শূন্য ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা ওই ব্যাংকগুলোর শেয়ারের বিপরীতে কিছুই পাবেন না। এটা হতে পারে না।’ বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কঠোর প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। নির্বাচিত সরকার এলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে মার্জার (একত্রীকরণ) প্রক্রিয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলো মার্জার করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ভুল প্রক্রিয়া। যদি মার্জার করতেই হয়, তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে সিদ্ধান্ত নেবে। দুই দিনের এই সরকার শেয়ারহোল্ডারদের ধ্বংস করে ব্যাংকগুলোকে মার্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন তলানিতে। নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজার ভালো করা যাচ্ছে না।’
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। সবগুলো ব্যাংকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
শেয়ারবাজারের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এক্সিম ব্যাংকের ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ (প্রায় ১৪৪ দশমিক ৭৫ কোটি শেয়ার) প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে, বাকি ৩২ দশমিক ৪৪ শতাংশ উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৪ দশমিক ১০ শতাংশ (৮০ দশমিক ৩৬ কোটি শেয়ার) সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বাকি ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ উদ্যোক্তা-পরিচালকদের। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ (৮৩ দশমিক ৫ কোটি শেয়ার) বিনিয়োগকারীদের হাতে, আর ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৮৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ (১১৪ দশমিক ০১ কোটি শেয়ার) বিনিয়োগকারীদের, ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের।
ইউনিয়ন ব্যাংকে ৪৫ দশমিক ৫১ শতাংশ (৪৭ দশমিক ১৬ কোটি শেয়ার) বিনিয়োগকারীদের, আর ৫৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে।
বিএসইসির নতুন মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করছি। আলোচনা চলছে এবং আশা করি সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে।’
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাঁচটি ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নেতিবাচক খবর প্রচার করার পর থেকে গত তিন মাসে এসব ব্যাংকের শেয়ারের দাম অব্যাহতভাবে কমে গেছে। ২০২২ সালে তালিকাভুক্ত গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর আলোচ্য সময়ে ৩ দশমিক ২ টাকা থেকে ১ দশমিক ৭ টাকায় নেমে এসেছে। ২০০৮ সালে তালিকাভুক্ত ফার্স্ট সিকিউরিটির শেয়ারদর ৪ দশমিক ৫ টাকা থেকে ১ দশমিক ৯ টাকায়, ২০০৪ সালে তালিকাভুক্ত এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারদর ৬ দশমিক ৫ টাকা থেকে ৩ টাকায়, ২০০০ সালে তালিকাভুক্ত সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর ৮ দশমিক ৫ টাকা থেকে ৩ টাকায় এবং ২০২২ সালে তালিকাভুক্ত ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ারদর ৩ দশমিক ১ থেকে ১ দশমিক ৫ টাকায় নেমে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পতন পুরো ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ মনোভাবের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে এখন ৩৬টি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে এখন মাত্র ডজনখানেক ব্যাংকের শেয়ার ১০ টাকা মূল্যমানের (ফেস ভ্যালু) ওপরে লেনদেন হচ্ছে।
একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের নবনিযুক্ত প্রশাসকরা গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে কাজ করতে শুরু করেছেন। আগের দিন তারা এসব ব্যাংকের দায়িত্ব নেন। প্রাথমিকভাবে তারা ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক বা সচল করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসকরা নিজ নিজ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক সভা করেছেন। পাশাপাশি কোনো কোনো প্রশাসক সারা দেশের শাখা ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে অনলাইনে সভা করেছেন। কেউ কেউ গ্রাহকদের সঙ্গেও আলোচনা করতে চান। এ জন্য তারা গ্রাহক সমাবেশ করার পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।
গতকাল ঢাকায় এসব ব্যাংকের কয়েকটি শাখা ঘুরে দেখা গেছে, কোনোটিতেই এখনো গ্রাহকের তেমন উপস্থিতি নেই। ফলে টাকা উত্তোলনের চাপও নেই।
গত বুধবার ব্যাংক পাঁচটিতে প্রশাসক নিয়োগের আদেশ জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শওকাতুল আলম এক্সিম ব্যাংকের, নির্বাহী পরিচালক সালাহ উদ্দিন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এবং নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান দিদার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মো. মোকসুদুজ্জামান গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এবং আরেক পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম ইউনিয়ন ব্যাংকের একই দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তাকে প্রতিটি ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসক পদগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ২৫ কর্মকর্তা দায়িত্ব পেলেন।
এই পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর এমডিদেরও পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। গতকাল পদত্যাগ করেন ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি হুমায়ুন কবির এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি শাফিউজ্জামান। অন্য তিন ব্যাংকে এমডির পদ শূন্য রয়েছে। ফলে প্রশাসকরা এখন ব্যাংক পাঁচটি একীভূতকরণের উদ্যোগ নেবেন। এই পাঁচ ব্যাংক মিলে গঠন করা হবে নতুন এক ব্যাংক।
এদিকে নতুন ব্যাংক গঠনের বিষয়ে চলতি মাসেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। যে ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ প্রস্তুত থাকবে, সেই ব্যাংকের সম্পদ, দায় ও জনবল আগে অধিগ্রহণ করবে নতুন ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গতকাল সন্ধ্যায় পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসক দলগুলোর সঙ্গে একযোগে অনলাইনে সভা করেন। এ সময় তিনি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব নেওয়ায় গ্রাহকরা শান্ত আছেন। তাদের আস্থা ফিরে আসছে। তখন গভর্নর ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক করাসহ একীভূত করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
