অত্যাধুনিক চারতলা কার্গো ভিলেজ হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (৫ নভেম্বর) : রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। আধুনিক সুবিধা-সম্পন্ন চারতলা কার্গো ভিলেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ‘ফ্যাব্রিকেটেড স্ট্রাকচার’ তৈরিতে দক্ষ একটি প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে। সরকারের লক্ষ্য— দ্রুত কার্গো ভিলেজ পুনর্গঠন করে এর কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা।

সম্প্রতি বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং দ্রুত কার্গো ভিলেজ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কার্গো ভিলেজ হচ্ছে বিমানবন্দরে এমন একটি এলাকা, যেখানে আমদানি ও রপ্তানির পণ্য শুল্ক প্রক্রিয়ার জন্য সংরক্ষণ করা হয়। অনেক বিমানবন্দরে আলাদা আলাদা কার্গো কমপ্লেক্স থাকে। শুল্ক প্রক্রিয়া শেষে আমদানিকারক বা তাদের প্রতিনিধি পণ্য বুঝে নেন। কিছু ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানি পণ্য দ্রুত পাঠাতে হয়, আবার কখনও কার্গো বিমানে জায়গা সংকটের কারণে কয়েক দিন ভিলেজে পণ্য রাখতে হয়।

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কার্গো ভিলেজের স্থানে একটি আধুনিক ডিজাইনের চারতলা কার্গো ভিলেজ নির্মাণের প্রস্তাব এসেছে। মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত প্রেজেন্টেশনে নতুন ভবনের নকশা ও বাস্তবায়নসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকারের মূল লক্ষ্য দ্রুত পুনর্গঠন করে কার্যক্রম শুরু করা।

ফ্যাব্রিকেটেড স্ট্রাকচার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটি আনুষ্ঠানিক মিটিং ছিল না, বরং একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়েছে কার্গো ভিলেজকে আধুনিক ও পুনরুদ্ধারযোগ্য করার প্রস্তাব নিয়ে। কার্গো ভিলেজে বিপুল পরিমাণ পণ্য লেনদেন হয়, তাই দ্রুত কার্যক্রম চালু করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

তিনি আরও জানান, প্রেজেন্টেশনে সরকারের জন্য কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া হয়— দুটি কনসালটেন্সি দ্রুত নিয়োগ দেওয়া, বর্তমান কাঠামোর অবস্থা মূল্যায়ন করা, একটি পরামর্শ কমিটি গঠন করে নতুন নকশা তৈরি করা এবং একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করা।

প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। প্রথমে একটি তদন্ত হবে, বুয়েট কাঠামোর বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করবে। এরপর কতটা জায়গা প্রয়োজন ও কেমন ভবন হবে তা নির্ধারণ করবে টেকনিক্যাল কমিটি। এরপর সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ভেন্ডার নির্বাচন করে নির্মাণকাজ শুরু হবে। খরচ এখনো নির্ধারণ হয়নি।

এ দিকে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কার্গো ভিলেজে নিরাপত্তাহীনতা, গুদাম ব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও পণ্য চুরির অভিযোগ ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগুনে ওষুধ, তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, ফলমূল ও হিমায়িত খাদ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে পারেন, যা ভবিষ্যতে রপ্তানি চুক্তি ও অর্ডারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ইএবি সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করেছে কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অকার্যকর এবং এটি বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর দায় এড়াতে পারবে না কেউ— না সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, না কাস্টমস, না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

তিনি আরও বলেন, বিমা দাবিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যেসব পণ্যের বিমা নেই, তাদের জন্য সরকারকে বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে হবে। ভবিষ্যতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্গো ভিলেজ আধুনিকায়ন, ওষুধ শিল্পের জন্য আলাদা শীত-নিয়ন্ত্রিত গুদাম এবং নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ জরুরি।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। পাশের কিছু দেশ চায় বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। এটি রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তাই গুদাম ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে।

অন্য দিকে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব মো. জাকির হোসেন জানান, কার্গো ভিলেজে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এতে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এই অগ্নিকাণ্ড বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট করতে পারে। তাই দ্রুত তদন্ত, দোষীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন, গুদাম ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি ও ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্গো ভিলেজকে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় রূপান্তর করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ