শিল্পাঞ্চলের জমি প্রভাবশালীদের দখলে

নিজস্ব প্রতিবেদক (নীলফামারী), এবিসি নিউজ, (২৩ সেপ্টেম্বর) : শিল্পসমৃদ্ধ জেলা গড়ার লক্ষ্যে নীলফামারীর ঢেলাপীরের কাদিখোল এলাকায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০৬ একর সরকারি খাস জমি শিল্পাঞ্চলের জন্য বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন। এ জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। লক্ষ্য ছিল নতুন উদ্যোক্তাদের স্বল্প মূল্যে জমি বরাদ্দ দিয়ে শিল্পায়নকে গতিশীল করা। এ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তর করা। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্বপ্ন আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বরাদ্দকৃত জমিতে নেই কোনো সীমানা প্রাচীর, নেই কোনো স্থাপনা। উল্টো জায়গাটি চলে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের দখলে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরাদ্দকৃত জমির বড় অংশজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই শতাধিক পাকা ও আধাপাকা বাড়িঘর। অনেক দখলকারী মহাসড়কের পাশে দোকানঘর ও গোডাউন তৈরি করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বাঁশের খুঁটির মাধ্যমে এসব দোকান ও ঘরবাড়িতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছেন। দেখে বোঝার উপায় নেই এ জমি আসলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ হওয়া সরকারি সম্পত্তি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতা ও বেজার নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েই দখলকারীরা বছরের পর বছর ধরে এখানে বসতি গড়ে তুলেছেন। এখন তারা জমির স্থায়ী মালিক বনে গেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘এ জমি বহু বছর ধরে খালি পড়ে ছিল। মহাসড়ক তৈরির সময় ইট বালু পাথর রাখা হয়েছিল। ফাঁকা পেয়ে অনেকেই এখানে ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করেন।’

সরকারি জমিতে বসবাসকারী আনিছুর ইসলাম বলেন, ‘জমি খালি ছিল তাই এখানে বাড়ি করেছি। এখন যদি উচ্ছেদ করা হয়, তবে আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।’

শুধু যে ফাঁকা জায়গা পেয়ে মানুষ ঘর তুলেছে তা নয়, এমন অনেকেই আছেন যারা প্রভাশালীদের টাকা দিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের দাবি, জমিগুলো তারা কিনে নিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমনই একজন বলেন, ‘আমি টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। জমি নিতে হলে আমার টাকা ফেরত দিতে হবে।’ কাকে টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এলাকার প্রভাবশালীদের দিয়েছি’।

মহাসড়কের পাশে একটি দোকান নিয়ে ব্যবসা করেন হোসেন রহমান। তিনি ঘরটি ভাড়া নিয়েছেন। প্রতি মাসে দোকান মালিককে ভাড়াও দেন। দোকানের মালিকের নাম জানতে চাইলে বলেন, ‘মালিক চলে যেতে বললে চলে যাব। নাম বলতে পারব না। এসব জমি কেনাবেচার পেছনে প্রভাবশালীরা জড়িত।’

সরকারি জমি কেনাবেচার বিষয়ে সংবাদকর্মীদের কাছে কেউ স্বীকার না করলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অনেকেই দখলদার চক্রটির কাছ থেকে লাখ টাকার বিনিময়ে জমি কিনে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এরা (প্রভাবশালীরা) সব সময় কিছু গুন্ডা প্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে বের হয়। তারা জমি দখল করে পাকা স্থাপনা তৈরি করে কখনো ভাড়া দিচ্ছে আবার কখনো বিক্রি করছে। প্রশাসন এসে দেখে, লিখে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’

ব্যবসায়িক নেতারা বলছেন, নীলফামারীর ঢেলাপীর কাদিখোলে শিল্পাঞ্চলের জন্য জায়গা বরাদ্দ হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে তা আজ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবাদি জমিতে এর প্রভাব পড়ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু না হওয়ায় জেলায় নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে না। নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।

রানু অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুশীল কুমার বলেন, ‘বেজার জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। শিল্পাঞ্চল চালু না হওয়ায় আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। নির্ধারিত প্লট না পেয়ে আমরা কৃষিজমি কিনে উচ্চমূল্যে কারখানা গড়ে তুলছি। ফলে একদিকে আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে খরচ বেড়ে উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে পড়ছেন।’

ইসলাম সেমি অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শিল্প উদ্যোক্তারা ভেবেছিলাম শিল্পাঞ্চলে কম দামে জমি পাব। কিন্তু আট বছরেও কোনো বরাদ্দ হয়নি। এখন চড়া দামে কৃষিজমি কিনে কারখানা গড়তে হচ্ছে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কার্যক্রম চালু করার জন্য জমি আনুষ্ঠানিকভাবে বেজাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ