যুক্তরাজ্য এশিয়ার কালো টাকার সুরক্ষিত ঠিকানা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ, (২৩ সেপ্টেম্বর) : বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থপাচারের অন্যতম গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাজ্যের নাম দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। লাল ইটের অট্টালিকা, মেরিলেবোনের অভিজাত বাড়ি কিংবা মে ফেয়ারের প্রাসাদোপম ম্যানশন—এসব কেবল স্থাপত্যের সৌন্দর্য নয়, বরং বহু সময় অবৈধ অর্থে কেনা সম্পত্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর অবৈধ অর্থে গড়ে ওঠা এসব সম্পত্তি মালিকদের জবাবদিহির বাইরে রেখেছে।
তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোর তদন্তে নতুনভাবে প্রশ্ন উঠেছে—কীভাবে যুক্তরাজ্য এশিয়ার দুর্নীতিবাজদের অর্থের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট সোমবার এক প্রতিবেদনে জানায়, লন্ডনে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সম্পত্তির উৎস নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে মালয়েশিয়া। এর আগে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ দাইম জায়নুদ্দিনের ১৮ কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করে। এসবের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক ভবন, বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট।
মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশ থেকেও যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। গত মে মাসে ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) প্রায় ৯ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তি জব্দ করে, যা ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। পরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল আরও প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ডের সম্পত্তির খোঁজ পায়, যেখানে রয়েছে লন্ডনের মে ফেয়ার ম্যানশন, সারে কাউন্টির এস্টেট ও মার্সিসাইডের ফ্ল্যাট।
এমন অভিযোগ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। শেখ হাসিনার ভাতিজি ও ব্রিটিশ রাজনীতিক টিউলিপ সিদ্দিক সম্পত্তি কেলেঙ্কারির অভিযোগের জেরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পদ হারান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শেল কোম্পানি ও অফশোর কাঠামোর কারণে অবৈধ অর্থ বৈধ সম্পদের সঙ্গে মিশে যায়, ফলে উৎস নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, লন্ডনে অন্তত ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির অর্থে কেনা হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আজমি হাসান মনে করেন, লন্ডনের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশের অভিজাতদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাণিজ্যিক যোগাযোগ—সব মিলিয়ে লন্ডন দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছে নিরাপদ ও আকর্ষণীয় গন্তব্য। এ কারণেই দুর্নীতির টাকাও সহজেই এই বাজারে প্রবাহিত হয়।
অবৈধ অর্থে সম্পত্তি কেনার অভিযোগ বহু বছর ধরে আসলেও যুক্তরাজ্য আইনি পদক্ষেপে তুলনামূলক ধীর। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ক্যারিবীয় অঞ্চলের করস্বর্গগুলো—যেমন কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ বা ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ—এখনও বৈশ্বিক মানি লন্ডারিং নেটওয়ার্কের প্রধান কেন্দ্র।
গত তিন দশকে এসব রুট ব্যবহার করে অন্তত ৭৯টি দেশ থেকে ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি অবৈধ অর্থ যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছে।
লন্ডনের সম্পত্তি বাজার এখন শুধু ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক নয়, বরং বৈশ্বিক দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের এক বড় কেন্দ্র হিসেবে সমালোচিত। মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ—এশিয়ার একাধিক দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা এখানে অর্থ পাচার করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছেন। তবুও আইনি কাঠামোর ধীরগতি এবং অফশোর গোপনীয়তার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই প্রবণতা থামেনি।