সম্পর্কে তারা শালা-দুলাভাই লুটপাটে ছিলেন ভাই ভাই
আনোয়ার আজমী, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা, (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪) : আসাদুজ্জামান খান কামাল ও লতিফ ভূঁইয়া কামাল সম্পর্কে আপন শালা-দুলাভাই। তবে লুটপাট আর অবৈধ আয়ে ছিলেন ভাই-ভাই। হাতে হাত ধরে এগিয়েছেন ঢাকা থেকে কুমিল্লায়। সাম্রাজ্য গড়েছেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ধানমন্ডি এবং বরুড়া ও মনোহরপুরে।
আসাদুজ্জামান খান কামাল ছিলেন হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর দুলাভাইয়ের বদৌলতে লতিফ ভূঁইয়া কামাল হয়েছিলেন বরুড়া উপজেলার চেয়ারম্যান। তদন্তে নামা দুদকের কর্মকর্তারাও শালা-দুলাভাইয়ের অবৈধ সম্পদের তালিকা তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ঢাকা এবং কুমিল্লায় অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, আসাদুজ্জামান খান কামাল, লতিফ ভূঁইয়া কামালসহ তাদের পরিবারের অবৈধ আয়ের মূল উৎস্যই ছিল পুলিশে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি, ফায়ার সার্ভিস ও জেল পুলিশে নিয়োগ, অস্ত্র ও মদের বারের লাইসেন্স, নতুন গাড়ি আমদানি, দখল বাণিজ্য, নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ। এসবে ছিল বিশাল সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন শ্যালক লতিফ ভূঁইয়া কামাল। এই সিন্ডিকেটেই তাদের প্রতি মাসে আয় ছিল প্রায় শতকোটি টাকা।
শালা-দুলাভাইয়ের এমন সব অবৈধ আয় এবং অপকর্ম অজানা ছিল না কারোরই। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ১৫ বছরে শূন্য থেকে অবৈধ পথে হাজার কোটি টাকা আর সম্পদের মালিক হয়েছেন আলোচিত এই দুজন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার অপরাধে পালিয়ে থাকা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে।
ইতোমধ্যে তার দুর্নীতির সবধরনের তথ্য অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১৫ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে। কমিটিতে আরও রয়েছেন- সংস্থাটির উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ, মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন ও মোহাম্মদ জিন্নাতুল হোসাইন। আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তার পরিবারের ৩২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া কয়েকশ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে কানাডা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা কয়েকজন সন্ত্রাসীর বাণিজ্যে অর্থলগ্নীর অভিযোগ রয়েছে আসাদুজ্জামান খান কামালের পুত্র সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি এবং শ্যালক লতিফ ভূঁইয়া কামালের বিরুদ্ধে। যদিও তার হাজারো কোটি টাকার মালিক হওয়া পুত্র জ্যোতিকে গত শুক্রবার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাকে চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক তথ্য বেরিয়ে আসছে।
‘মাফিয়াদের গডফাদার’ ছিলেন তিনি। তার নিয়ন্ত্রণে ছিল বড় দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের সব সদস্য এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। দুদকে দায়ের করা অভিযোগে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে ‘সিন্ডিকেট’ করে ‘বস্তায় বস্তায়’ ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান এবং তাদের ছেলে-মেয়ের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশে।
আসাদুজ্জামান খান কামাল সবারই পরিচিত। তেজগাঁও এবং ধানমন্ডি এলাকায় রয়েছে তার বিশাল সাম্রাজ্য। বিশাল বলয় তৈরি করে পর পর তিনবার ভোটারবিহীন নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ থেকে থেকে টানা ২০২৪ এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সময়ে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা এবং সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে আসাদুজ্জামান খান কামাল আছেন আত্মগোপনে। যৌথবাহিনী হণ্যে হয়ে খুঁজছে তাকে।
লতিফ ভূঁইয়া কামাল আসাদুজ্জামান খান কামালের আপন শ্যালক। স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খানের বড় ভাই। এটাই ছিল লতিফ ভূঁইয়া কামালের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এই পরিচয়েই তিনি ভাগ্য বদল করে দশ বছরে শূন্য থেকে কোটিপতিদের সারিতে পৌঁছে যান। এক সময় কুমিল্লা শহরের পৈতৃক বাড়িতে লেদ মেশিন বসিয়ে রিকশার স্ক্রু বানাতেন। ভ্যানগাড়িতে করে তা সরবরাহ করতেন।
দুলাভাইয়ের হাত ধরে আস্তে আস্তে বদলে ফেলেন নিজেকে। কুমিল্লার বাড়িতে প্রতিদিন ভিড় করতেন শত শত চাকরিপ্রার্থীরা। পুলিশের উর্ধ্বতনরাও আসতেন তদবিরে। অঢেল অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার পর লতিফ ভূঁইয়া কামালের সাধ জেগেছিল ‘বরুড়া’ উপজেলার চেয়ারম্যান হওয়ার। দুলাভাইয়ের কাছে আবদার জানালেন। দুলাভাই শ্যালকের এ আবদার ফেলতে পারেননি। স্থানীয়দের কাছে অচেনা-অজনপ্রিয় লতিফ ভূঁইয়া কামালকে দাঁড় করিয়ে দিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। র্যাব-পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের পাহাড়ায় দেওয়া ভোটে বিজয়ী হন। হারিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান মঈনুল ইসলামকে। নির্বাচনের দিন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান ও তার পুত্র জ্যোতি বরুড়ায় অবস্থান করেন। তাদের পরিকল্পনায়ই অবৈধ পথে নির্বাচিত হন লতিফ ভূঁইয়া কামাল। তবে সরকারের পতনের পর পলাতক থাকায় তাকে বরখাস্ত করা হয়।
স্ত্রী তাহমিনা খানের দখলে অবৈধ সম্পদ:পালিয়ে থাকা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অবৈধ অর্থে গড়া সাম্রাজ্য ছিল ঢাকা এবং কুমিল্লায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, তার এই সাম্রাজ্য দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান। ভাই লতিফ ভূঁইয়া কামালকে সঙ্গে নিয়ে এ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তিনি।
আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকায় তিনি শুধু ‘মানি ইনকাম’ এর দায়িত্ব পালন করতেন। পুত্র সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি এসব অর্থ সংগ্রহ এবং তা মায়ের (লুৎফুল তাহমিনা খান) কাছে পৌঁছে দিতেন। মূলত এই পরিবারের সব অবৈধ অর্থ জমা এবং হিসাব-নিকাশ ছিল লুৎফুল তাহমিনা খানের কাছে। এই কারণেই আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রীর (বড় বোন) মৃত্যুর পর দুলাভাইকে বিয়ে করেন তার অবৈধ সাম্রাজ্য নিজেদের দখলে রাখতে। সফলও হয়েছেন তিনি। ভাই লতিফ ভূঁইয়া কামালকে সঙ্গে নিয়ে সামলে রেখেছেন সব সম্পদ। তবে গত মঙ্গলবার আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান এবং তাদের ছেলে-মেয়ের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
আসাদুজ্জামান খান কামালের সাম্রাজ্য :
পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৩২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া আরও ২০০ কোটি টাকার বেশি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ছেলে শাফি মোদ্দাসির খান, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান এবং সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেনকে আসামি করে মামলা চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই মামলা দায়ের করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
অর্থ আয়ে সহায়তা করতেন যারা :
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অবৈধ আয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশীদ, যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেনের বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়, টাকা আদায়ে মূল ভূমিকা ছিল হারুন অর রশীদের। ‘হাজার হাজার কোটি টাকা’ হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। হারুন অবসরে গেলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতিতে ছিলেন তিনি। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে পাওয়া টাকা আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে পাঠানো হতো দেশের বাইরে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এসপি বদলিতে ১ বছরের জন্য ১ কোটি টাকা, স্থান ভেদে ২ থেকে ৩ কোটি টাকাও দিতে হতো। এর মিডিয়া করতেন এপিএস মনির হোসেন ও শরীফ মাহামুদ অপু। ঘুষের এই টাকা রাতে ধানমন্ডির বাসায় আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হতো। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আসাদুজ্জামান খান কামাল গত দশ বছরে পুলিশের এসপি, ওসি ও এসআই বদলি, পদায়ন ও নিয়োগে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এর পাশাপাশি তিনি পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের লাইসেন্স পাইয়ে দিয়ে ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন শতকোটি টাকা।
লতিফ ভূঁইয়া কামালের সাম্রাজ্য কুমিল্লায় :
লতিফ ভূঁইয়া কামালের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরপুরে। চার বোন দুই ভাই তারা। পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আপন শ্যালক তিনি। এটাই ছিল লতিফ ভূঁইয়া কামালের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এই পরিচয়েই তিনি ভাগ্য বদল করে দশ বছরে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন। শতকোটি টাকা ব্যয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ‘বরুড়া’ উপজেলার চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তবে এখন পলাতক থাকায় বরখাস্ত হয়েছেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, লতিফ ভূঁইয়া কামালের কুমিল্লায় রয়েছে অঢেল সম্পদ। মনোহরপুরে ডুপ্লেক্স বাড়ি, কুমিল্লার কাপ্তান বাজারে বাড়ি, কয়েক বিঘা জমি, প্লটের পাশাপাশি রয়েছে ট্রাক ও লড়ির মালিকানা। কক্সবাজারে রয়েছে রিসোর্ট, চট্টগ্রামে দুটি জাহাজ, বসুন্ধরা ও মগবাজর ওয়ারলেসে ফ্ল্যাট। এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবসায় তার অর্থলগ্নী অর্থাৎ ডিলারশিপ নিয়েছেন বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাস ও ফুড অ্যান্ড বেভারেজে। খুলনার মোংলা থেকে এলপিজি গ্যাস আনার ট্রাক আছে বেশ কয়েকটি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে আসাদুজ্জামান খান কামালের ফার্মগেটস্থ মনিপুরি পাড়ার বাসা এবং লতিফ ভূঁইয়া কামালের বরুড়ার বাসায় গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যবহার করা মোবাইলটিও বন্ধ পাওয়া যায়।