জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি,
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র (২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮) : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পরিবর্তন ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। জনাব সভাপতি, আসসালামু আলাইকুম এবং শুভ সন্ধ্যা।
জাতিসংঘের ৭৩ বছরের ইতিহাসে চতুর্থ নারী হিসেবে সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। জাতিসংঘের প্রতি আপনার অঙ্গীকার সুরক্ষায় আপনার যেকোনো প্রচেষ্টায় আমার প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে থাকবে অকুণ্ঠ সহযোগিতা।

একই সঙ্গে বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমি জাতিসংঘের মহাসচিব জনাব অ্যান্টনিও গুটেরেসকে অভিবাদন জানাই।

জনাব সভাপতি, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের জন্য আপনার নির্ধারিত প্রতিপাদ্য আমাকে অতীতের কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতায় নিয়ে গেছে। চুয়াল্লিশ বছর আগে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যা বলেছিলেন আমি তা উদ্ধৃত করছি ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সকল নর-নারীর গভীর আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে রয়েছে। এই দুঃখদুর্দশা-সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল।’

জনাব সভাপতি, আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। যেখানে ৯০ ভাগ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করতো। দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭১ সালে। এই দীর্ঘ সংগ্রামে প্রায় ১৪ বছরই তিনি কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল বার বার।

স্বাধীনতা অর্জনের পর একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত, অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। দেশের মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের জনগণের। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একই সঙ্গে তারা আমার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা, আমার তিন ভাই, যাদের মধ্যে ছোট ভাইটির বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর, নবপরিণীতা দুই ভ্রাতৃবধুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করে। আমি ও আমার ছোটবোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলাম বলে বেঁচে যাই। কিন্তু আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। সে সময়কার ক্ষমতা দখলকারী সামরিক একনায়ক ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। আমরা এই নৃশংস হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকার পর্যন্ত হারিয়েছিলাম।

জনাব সভাপতি, বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক নিপীড়িত ও রোহিঙ্গাদের মত নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ জাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল মিয়ানমারের ঘটনা সে কথাই বার বার মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানীরা ৩০ লাখ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। ২ লাখ নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এক কোটি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার বাবাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আমার মা, ছোট দুই ভাই, বোনসহ আমিও বন্দি হই। সে সময় আমি সন্তান-সম্ভবা ছিলাম। আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় বন্দি অবস্থায়। নোংরা ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে আমাদের থাকতে হত।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাতে আমরা হতভম্ব। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ