সৌভাগ্যের আরব নাকি যুদ্ধক্ষেত্র !

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ইয়েমেনকে আগে ‘সৌভাগ্যের আরব’ বলা হতো। এখন দেশটিতে সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটাও নেই। একটু পরপরই শোনা যায় বোমা আর গুলির শব্দ। আর্তনাদ, আহাজারিতে বাতাস ভারী। কয়েক বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে ইয়েমেন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার বদলে আরব অঞ্চলের দুই শক্তিধর দেশের মর্যাদার লড়াইয়ের মঞ্চে পরিণত হয়েছে ইয়েমেন।

সম্প্রতি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের এক হাজার দিন পূরণ হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, দেশটির ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে ২ কোটি মানুষেরই মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। অর্থাৎ ইয়েমেনের জনগণের দুই-তৃতীয়াংশ মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেশটি এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অন্যদিকে, এত দিনের যুদ্ধে ভেঙে পড়েছে পানি সরবরাহব্যবস্থা থেকে শুরু করে সুয়ারেজ ব্যবস্থা পর্যন্ত নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব সেবাকাঠামো। ইয়েমেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক কলেরা সংক্রমণ দেখা দিয়েছে যুদ্ধের কারণে। এরই মধ্যে কলেরায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। আর জ্বালানি সংকটের কারণে স্থানীয় হাসপাতালগুলোকে বাধ্য হয়ে একে একে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী যন্ত্র। একই সঙ্গে নিহত হওয়ার পরিসংখ্যানের টালি বাড়ছে একটু একটু করে।

একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা কার্ল-ওট্টো জেন্টেল সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলেতে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ইয়েমেনের সরকারি কর্মকর্তারা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের অবস্থাও তথৈবচ। সাধারণ মানুষ এখন নিজেদের সঞ্চয় থেকে খরচ মেটাচ্ছেন। দেশে কাজের অভাব হলে জীবিকা নির্বাহের জন্য গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ কিছুদিন আগেও সীমান্ত পেরিয়ে তিন-চার মাসের জন্য সৌদি আরবে চলে যেত। কিন্তু এখন সীমান্ত বন্ধ থাকায় তারও উপায় নেই।

কার্ল-ওট্টো জেন্টেল বলেন, মার্কিন মদদপুষ্ট সৌদি সামরিক জোটের আরোপ করা অবরোধই ইয়েমেনের মানুষের বর্তমান সীমাহীন দুর্গতির কারণ। গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ অবরোধ আরোপ করা হয়। অবরোধের কারণে স্থল, সমুদ্রবন্দর দিয়ে এবং আকাশপথে দেশটিতে ঢোকা যাচ্ছে না। এতে উত্তর ইয়েমেনে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ প্রভৃতি মানবিক সহায়তা সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া দেশটির প্রধান খাদ্যপণ্যগুলো সমুদ্রপথে আমদানি করতে হয়। কিছু আবার সৌদি আরবের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চল দিয়ে ইয়েমেনে ঢোকে। কিন্তু সাম্প্রতিক অবরোধ ও উত্তর ইয়েমেন হুতি বিদ্রোহীদের দখলে থাকার কারণে সবই স্থবির।

দ্য ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইয়েমেনের এই যুদ্ধ নিয়ে আদতে মাথাই ঘামাচ্ছে না বিশ্বের অন্যান্য দেশ। যেন কোনো যুদ্ধই নেই! স্রেফ নির্বিকার রয়েছে বিশ্বরাজনীতির মোড়লেরা। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সংঘাত। এসবের কারণে ইয়েমেন আড়ালে পড়ে গেছে। অথচ উদ্যোগী হলে ইয়েমেন সংকট সমাধান অসম্ভব কিছু নয়। অন্তত সৌদি আরব ও ইরানের ছায়াযুদ্ধের বলি হতে হতো না দেশটিকে।

অথচ এই অবহেলার কারণে এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখানোর শঙ্কায় ইয়েমেন। আরেকটি আফগানিস্তান বা সোমালিয়া সৃষ্টি হলে তা হয়ে উঠবে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের উর্বর ক্ষেত্র। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ সম্প্রতি জানিয়েছে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) প্রভাবশালী দেশটির দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে। সংঘাতময় পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হবে, এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর শক্তিমত্তা ততই বাড়বে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সুয়েজ খালে ঢোকার পথ বাব আল-মান্দেব প্রণালি কার্যত আছে ইয়েমেনের হাতে। সুতরাং সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ মন থেকে না চাইলেও আসলে নানাভাবেই ইয়েমেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশ্চিমা বিশ্ব। তা ছাড়া দেশটিতে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের ব্যবহৃত সমরাস্ত্রের বেশির ভাগই তো পশ্চিমা প্রযুক্তিতে তৈরি। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণও করছে পশ্চিমা দেশের তৈরি করা কৃত্রিম উপগ্রহ। সংঘাতে থাকতে পারলে শান্তিতে কী সমস্যা?

সংকটের শুরু যেভাবে
২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার শুরু। তা থেকে রেহাই পায়নি ইয়েমেনও। দেশটিতে তখন গণবিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকে হত্যা করতে ওই সময় বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তবে কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন সালেহ। পরে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। সালেহ ছিলেন একতাবদ্ধ ইয়েমেনের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট। টানা ৩৩ বছর এই একনায়ক ক্ষমতায় ছিলেন।

সালেহর পর ক্ষমতায় আসেন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদি। ২০১৫ সালে একটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়, ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি পার্লামেন্ট গঠন করা হবে। এ ছাড়া খসড়া সংবিধানে ফেডারেল ব্যবস্থার সরকার গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু হুতি বিদ্রোহীরা প্রত্যাখ্যান করায় এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

হুতিরা মূলত শিয়াদের প্রতিনিধিত্ব করে। ইয়েমেনের ৪০ শতাংশ মানুষ শিয়া অনুসারী। খসড়া সংবিধান প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি মনসুর হাদিকে বহিষ্কারও করে হুতি বিদ্রোহীরা। সংঘর্ষের একপর্যায়ে রাজধানী সানার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায় তারা। তখন সৌদি জোটের পাল্টা আক্রমণে আবার পিছু হটে ইরানের আশীর্বাদধন্য হুতিরা। ঠিক এই সময়েই আবার দৃশ্যপটে হাজির হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে জোট বাঁধেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি সেই সম্পর্কেও চিড় ধরে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, গত আগস্ট মাসে হুতিদের ‘মিলিশিয়া’ আখ্যা দেন সালেহ। এর পাল্টা হিসেবে সাবেক প্রেসিডেন্টকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করে হুতিরা।

৪ ডিসেম্বর সালেহকে হত্যা করেছে হুতি বিদ্রোহীরা। এ ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা মধ্যপ্রাচ্য। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ইয়েমেন পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুরু হয়ে গেছে অবরোধ ও পাল্টাপাল্টি রকেট হামলা।

সমাধান কী?
দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়, পুরো ইয়েমেনে শাসনকাজ চালানোর মতো শক্তি হুতি বিদ্রোহীদের নেই। আবার সৌদি আরবের পক্ষে হুতিদের পুরোপুরি পরাজিত করাও সম্ভব নয়। কারণ, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে একেবারে মিশে গিয়ে লড়াই চালাচ্ছে বিদ্রোহীরা। ইয়েমেনে আদতে স্থানীয় দুই পক্ষের আড়ালে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে সৌদি আরব ও ইরান। আর বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ বেসামরিক জনগণ।

ডয়চে ভেলেতে লেখা নিবন্ধে কার্ল-ওট্টো জেন্টেল বলেন, সালেহ নিহত হওয়ার কারণে বিশেষ করে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে সংঘাত নতুন করে দেশটির বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সব পক্ষের সম্মতিতে একটি শান্তিচুক্তি ছাড়া এ অবস্থার অবসান হওয়া সম্ভব নয়।

আল-জাজিরায় লেখা নিবন্ধে ইয়েমেনের গবেষক নাদওয়া আল-দোসারি বলেছেন, শুধু সৌদি আরব ও ইরান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক আঞ্চলিক শক্তি এখন ইয়েমেনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে নাক না গলালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

কিন্তু জাতিসংঘ কী করছে? হুতি বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের আগাম শর্ত দিয়ে শান্তি আলোচনা শুরু করেছে জাতিসংঘ। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ একদমই অবাস্তব। বরং যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে ওমান বা কুয়েতের মতো দেশগুলোকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। কোনো পূর্ণ চুক্তি ছাড়া এই সংঘাতের সমাধান সম্ভব নয়।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা নিবন্ধে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড জোর দিয়েছেন তিনটি পদক্ষেপের ওপর। প্রথমত, সৌদি সরকারের আরোপিত সব ধরনের অবরোধ তুলে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, আপসের ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, সংঘাতে জড়িত সব পক্ষকে নিয়ে শর্তহীন শান্তি আলোচনা শুরু করতে হবে।

ডেভিড মিলিব্যান্ড বলেন, শান্তি আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর কোনো বিকল্প নেই। সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও লিবিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক কূটনীতি নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রক্ষমতা বৈধ ও বিশ্বাসযোগ্য শাসকের হাতে না থাকলে, শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ নেই। আর যেখানে শান্তি নেই, সেখানে অস্থিরতা ও মানবিক বিপর্যয় অবধারিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ