পুলিশ বলল ‘দে’, চোরাচালানি গুঁজে দিল টাকা

Benapol Train বেনাপোলরিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, যশোরঃ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা। যশোরের বেনাপোল রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কমিউটার ট্রেন চালু হলো। মাথা, ঘাড়ে ও কাঁখে করে বড় বড় বস্তা ও কার্টন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ট্রেনে উঠছেন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। ওই বস্তা আর কার্টনের সাতকাহন জানার জন্য ট্রেনে উঠে পড়লাম। পৌনে একটায় বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেনের পাঁচটি বগির সর্বত্র বস্তা ও কার্টন। টয়লেটের ভেতরেও বস্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চতুর্থ বগিতে গিয়ে বসতেই জিরা-মসলার ঝাঁজাল গন্ধ নাকে এল।
বস্তা ও কার্টন নিয়ে বসে থাকা নারী-পুরুষের কথোপকথন চলছে। এগিয়ে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এক নারী বললেন, ‘তিন বস্তা মাল আনতি ২১০ টাকার স্লিপ কাটতি হলো। শালারা কী মানুষ। শুধু রেট বাড়ায়।’
পুরুষটি বললেন, ‘কী কী আনলি?’
নারীর উত্তর: ‘জিরে, কিশমিশ, চকলেট আর কয়ডা থ্রি-পিছ।’
এর মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা আফতাব ও আকবর নামের প্লেট ঝোলানো দুজন গিয়ে ওই নারীকে বললেন, ‘দে।’
ওই নারী অভ্যাসবশত কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আগে থেকে হাতের মুঠোয় রাখা টাকা গুঁজে দিলেন পুলিশের হাতে।
টাকা হাতে নিয়ে আকবর মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘কয় বস্তা?’

…‘তিন বস্তা।’
…‘কত দিলি?’
…‘৬০ টাকা।’
…‘ক্যান? ৯০ টাকা দিবি। প্রতি বস্তা এখন ৩০ টাকা।’
…‘আর দিতি পারব না।’

রাগ দেখিয়ে কোমর থেকে আরও ১০ টাকার একটি নোট বের করে পুলিশের হাতে গুঁজে দিলেন নারীটি।
দুই পুলিশ এবার এগিয়ে গেলেন বগির বস্তাওয়ালা অন্যদের কাছে। সবার কাছে গিয়ে দর-কষাকষি করে টাকা তুললেন। শেষ হওয়ার পরে চলে গেলেন আরেক বগিতে।

নারীর কাছে জানতে চাইলাম, বিষয়টি কী? ওই নারী মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, ‘কয়ডা মাল আইনে, নানা জাগায় টাকা দাও। স্লিপ কাটলাম ২১০ টাকায়, পুলিশের দিলাম ৭০ টাকা। খুলনা পর্যন্ত যাতি আরও কত জায়গা যে দিতি হবে।’

ট্রেন যশোর রেলওয়ে জংশনে থামল। দুই পুলিশ আফতাব ও আকবর ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করছেন। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

‘কত উঠল?’
দুজন ইতস্তত করে দুজনের মুখের দিকে তাকালেন। পুলিশ আকবর বললেন, ‘আপনার পরিচয়?’
পরিচয় দিতেই তিনি একটু দমে গিয়ে বললেন, ‘না, টাকা আর কই। এখন মাল তেমন আসছে না। দেখলেন না, ট্রেন ফাঁকা। চোরাকারবারিরাও এখন আর টাকা দিতে চায় না। নানা কৌশলে এড়িয়ে যায়। ওদিকে বিজিবি (বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন) আবার কড়াকড়ি আরোপ করেছে। সীমান্ত থেকে তারা (বিজিবি) টাকা নিয়ে মাল ছেড়ে দিয়ে বাইরে থেকে আবার ধরাধরি করে। বেনাপোল রেলস্টেশনেও তারা অভিযান চালায়ে চোরাচালানিদের মারধর করে।’
আকবর বলেন, ‘ভাই, আমার বাড়িও যশোরে। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক আমার বন্ধু। আপনি এতকিছু জেনে কী করবেন?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আফতাব বলে বসলেন, ভাইকে কিছু টাকা দিয়ে দাও। একটু ধমক দিতেই তাঁরা চুপসে গেলেন। এর মধ্যে ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বেজে উঠল। তাঁরা ট্রেনে উঠে পড়লেন।

জানতে পারলাম দুজনেই রেলওয়ে পুলিশের খুলনা কার্যালয়ে কর্মরত। আফতাব হাবিলদার ও আকবর কনস্টেবল। চোরাচালানিদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ নিয়ে কথা বললাম রেলওয়ে পুলিশের খুলনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, হাবিলদার আফতাব আর কনস্টেবল আকবরের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কোথা থেকে আসেন চোরাচালানিরা কারা কীভাবে চোরাচালানি করে, সেটি দেখার জন্য যশোর রেলওয়ে জংশন থেকে বেনাপোলে যাওয়ার ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনের প্রতিটি বগি মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষে ঠাসা। সবার হাতে একটি করে প্যাকেট। ওই প্যাকেটের মধ্যে চটের বস্তা রয়েছে।
ট্রেনের একজন যাত্রী জানালেন, সামনে ঈদ। এখন একটু ভিড় বাড়বে। চোরাইপণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে।
এ কথা শুনে এক নারী বলে উঠলেন, ‘আমরা কাজ করে খাই। টাকা খাটাই। ব্যবসা করি। চুরি করিনে।’
নাভারণ স্টেশনে নারীদের অর্ধেক নেমে গেলেন। বাকিরা বেনাপোল স্টেশনে নেমে পড়লেন। গাতিপাড়া, পাতিপাড়া করে ইজিবাইকের চালকেরা চিত্কার শুরু করলেন। নারীরা সবাই গাতিপাড়ার ইজিবাইকে চেপে বসছেন। অন্তত ৫০টি ইজিবাইক গাতিপাড়ার দিকে গেল।
সবাই গাতিপাড়ার দিকে যাচ্ছেন কেন—জানতে চাইলে ইজিবাইকের এক চালক বলেন, ‘চোরাইপথে আসা ভারতীয় পণ্যের চার-পাঁচটি আস্তানা আছে গাতিপাড়ায়। সারারাত ভারতের তেরোঘর দিয়ে ওই মাল ওঠে। যার যতটুকু মালের অর্ডার, তার ততটুকু দিয়ে গাঁট বাঁধা আছে। স্লিপ কেটে ওই মাল তারা নিয়ে আসে। ফিরতি ট্রেনে ওরা আবার ফিরে যাবে।’

তেরোঘরে একদিন
তেরোঘর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বেনাপোল সীমান্তে ইছামতী নদীর এপারে বাংলাদেশ, ওপারে ভারত। এপারে সোয়া দুই একর ভূখণ্ডে আটঘর ভারতীয় নাগরিকদের বসতি। অতীতে এখানে তেরোঘর মানুষের বসবাস ছিল বলে জায়গাটি তেরোঘর নামে পরিচিত।

তেরোঘরের পশ্চিমে ইছামতী নদী। উত্তর-দক্ষিণে ৬০০ থেকে ৭০০ গজ দূরত্বে বিজিবির সীমান্ত পাহারার দুটি চৌকি (পোস্ট)। পূর্ব দিকে সীমানা পিলার দিয়ে ভারতীয় অংশ চিহ্নিত করা। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া বা পাহারার ব্যবস্থা নেই। ত্রিভুজাকৃতির এই ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব পাশে বেনাপোল ইউনিয়নের গাতিপাড়া ও বড় আঁঁচড়া গ্রাম। আর দক্ষিণের পুটখালী ইউনিয়নের দৌলতপুর ও পুটখালী সীমান্ত।
তেরোঘরের বাসিন্দাদের বাজার-সদাই, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চিকিত্সাসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে নৌকা নিয়ে তাদের নদীর ওপারে ভারতের আরও ভেতরে যেতে হয়। ফেরার সময় তারা নৌকার পাটাতনের নিচে করে অস্ত্র, ফেনসিডিল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, জিরা-মসলা, বিভিন্ন ধরনের চকলেটসহ ভারতীয় সব চোরাই পণ্য এনে তেরোঘরে মজুত করে রাখে। তাদের কাছ থেকেই সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশের গাতিপাড়াসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা সেসব নিয়ে আসে। সেগুলোই ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচকানাচে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ২৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিজিবির সদস্যরা টাকা নিয়ে পণ্য ঢুকতে সহায়তা করেন—এ অভিযোগ সত্য নয়। তবে চোরাচালানিরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তেরোঘর ভারতের অংশ। সেখানে ইচ্ছা করলেই আমরা ঢুকতে পারি না। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় রাতের আঁঁধারে তেরোঘর থেকে চোরাইপণ্য নিয়ে কেউ যদি সীমান্তের গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাহলে আমাদের কতটুকুই বা করার আছে। তা ছাড়া জনবল-সংকটের কারণে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ