জুলাইয়ের মুখ ওসমান হাদির অবস্থা সংকটাপন্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১৩ ডিসেম্বর) : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীতে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় লিফলেট বিতরণের সময় মোটরসাইকেলে আসা দুজন অস্ত্রধারী খুব কাছ থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তিনি এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করেছে। বিএনপি ঘটনাটিকে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ উল্লেখ করে আজ শনিবার ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরনের সহিংসতা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং দেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত’ চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। হামলার পর ঢাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং বিভিন্ন মোড়ে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল জুমার পর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট সড়কে বাইতুস সালাহ জামে মসজিদের উল্টো দিকের ‘ডক্টর টাওয়ার’-এর সামনে দিয়ে হাদি ব্যাটারিচালিত রিকশায় লিফলেট বিতরণ করে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে মোটরসাইকেল এসে রিকশার একদম কাছে গিয়ে চলন্ত অবস্থায় হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের পাশ দিয়ে মাথায় বিদ্ধ হয়। ঘটনার পর তাঁর সহকর্মীরা রিকশাতে করেই তাঁকে দ্রুত ঢামেকে নিয়ে যান।
গুলির সময় সাজ্জাদ খান নামের এক ব্যক্তি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী এই ব্যক্তি বলেন, ওসমান হাদি ফকিরাপুলের দিক থেকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে পশ্চিমে বিজয়নগরের দিকে যাচ্ছিলেন। রিকশার পাশের আসনে আরেকজন ছিলেন। দুই ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেলে করে অটোরিকশার পিছু নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করছিল। মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তির গায়ে কালো চাদর ছিল, যা দিয়ে তার হাত দুটি ঢাকা ছিল। অটোরিকশার পাশে এলে পেছনে বসা ব্যক্তি একটি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে খুব কাছ থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। মুহূর্তের মধ্যে তারা মোটরসাইকেল নিয়ে বিজয়নগরের দিকে চলে যায়।
সাজ্জাদ খান বলেন, গুলির শব্দে রাস্তায় থাকা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রিকশা থামালে ভিড় জমে যায়। এই সময় হাদির মাথা ও কান থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় পড়ছিল।
হাদির একজন সহযোদ্ধা বলেন, জুমার নামাজের পর মসজিদে তাঁদের লিফলেট বিলি কর্মসূচি ছিল। কথা ছিল, লিফলেট বিলি শেষে সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়ে দুপুরের খাবার খাবেন, আলোচনা করবেন। এর মধ্যেই হাদির ওপর হামলার খবর আসে।
ঘটনার পর পুলিশ, র্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীও যোগ দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ডক্টর (ডিআর) টাওয়ারে স্থাপিত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ব্যবহার করে হামলাকারীদের শনাক্তের কাজ শুরু করে।
গুলির একটি সিসিটিভির ভিডিওতে দেখা যায়, হাদির রিকশার খুব কাছে মোটরসাইকেলটি আসে, মুহূর্তেই আরোহী অস্ত্র বের করে গুলি করে এবং ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি গুলির খোসাও উদ্ধার করে পুলিশ। জানতে চাইলে মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, কে বা কারা কোন উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি।
তবে ইনকিলাব মঞ্চের একজন সদস্য গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, যারা ওসমান হাদির ওপর গুলি চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচারণা টিমে যোগ দিয়েছিল। সংগঠনের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্যে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি ছোড়ে। মাঝখানে কয়েক দিন তাদের দেখা যায়নি। কিছুদিন আগে তারা আবার এসে প্রচারণার কাজে যুক্ত হয়। গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ইতিমধ্যে ঘটনার ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা সব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন।
বিদেশি ফোন নম্বর থেকে হত্যার হুমকি
হাদি আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন, তাঁকে ‘হত্যার হুমকি’ দেওয়া হচ্ছে। গত নভেম্বর মাসে ৩০টি বিদেশি নম্বর থেকে ফোন ও বার্তার মাধ্যমে হুমকি পাওয়ার অভিযোগ করে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ১৩ নভেম্বর গভীর রাতে দেওয়া সেই পোস্টে আওয়ামী লীগকে দায়ী করে হাদি লেখেন, ‘গত তিন ঘণ্টায় আমার নম্বরে আওয়ামী লীগের খুনিরা অন্তত ৩০টি বিদেশি নম্বর থেকে কল ও টেক্সট করেছে; যার সারমর্ম হলো—আমাকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তারা আমার বাড়িতে আগুন দেবে, আমার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণ করবে এবং আমাকে হত্যা করবে।’
ঢামেক ছেড়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, হাদির মাথার ভেতরে গুলি রয়েছে এবং তাঁর সার্জারি চলছিল। হাসপাতালে আনা স্বজনেরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা মাত্র একটি গুলিই ছোড়ে, সেটিই তাঁর মাথায় লাগে।
ওসমান হাদির সতীর্থরা ঢাকা মেডিকেলে ‘বি নেগেটিভ’ রক্ত খুঁজছিলেন। তাঁরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে হাদির প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। চিকিৎসকেরা রক্ত জোগাড় করতে বলেছেন। ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়।
সন্ধ্যার পর হাদির পরিবার তাঁকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক আসাদুজ্জামান জানান, প্রাথমিক অস্ত্রোপচারের পর পরিবারের অনুরোধে তাঁকে এভারকেয়ারে পাঠানো হচ্ছে এবং সেখানে চিকিৎসার সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
মনোয়ারুল হক/
