ভ্যাট আদায় হলেও অনেক সময় সরকারের কোষাগারে পৌঁছায় না: অর্থ উপদেষ্টা
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১১ ডিসেম্বর) : আমাদের দেশে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ভ্যাট আদায় হলেও অনেক সময় তা সরকারের কোষাগারে পৌঁছায় না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নয়নের জন্য ভ্যাট একটি মডার্ন সিস্টেম। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। জিডিপির তুলনায় ভ্যাট তেমন নেই।
তিনি বলেন, বিদেশে ভ্যাট দেওয়া ছাড়া ক্রয় করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে সব স্থানে ভ্যাটের বিষয়টি পৌঁছায়নি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কর-জিডিপি অনেক কম। সরকারের সম্পদ না বাড়ালে কাজ করব কীভাবে? রাজস্ব বাড়াতে হবে। কোনো কোনো দেশে কর-জিডিপি অনুপাত ২৬ শতাংশের কারণে সে দেশ সেবা পায়। আমাদের দেশে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যেমন–আমাদের দেশে যদি হাসপাতাল ও শিক্ষায় সেবা পাওয়া যায়, তাহলে মানুষ স্বেচ্ছায় রাজস্ব দিতে এগিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, এনবিআরকে বলব পরিধি বাড়ান, আধুনিকায়ন করেন। সম্পূরক ডিউটি কমান। না হলে বেশি আগানো যাবে না। কর দিলাম, সেবা পাব না। কর দিলে কী লাভ হলো, এই প্রশ্ন যেন করতে না পারে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে ও থাকবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, অনেক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মোমেনটাম তৈরি হয়েছে। সেটাকে ধরে রাখতে হবে। অটোমেটেড করা বড় সাফল্য। ভ্যাট অব্যাহতি কমেছে। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি হয়েছে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, রাজস্ব আহরণ হচ্ছে মধু আহরণের মতো। সে কারণে করদাতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাকে সোনার ডিম পারা হাঁসের মতো মেরে ফেললে তো হবে না। হয়রানি বা জুলুম করা যাবে না।
আবদুর রহমান খান বলেন, ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ২০১২ সালে এসে ধাক্কা খায়। নতুন আইন ১৯৯১ সালের আইনের চেয়ে সহজ হওয়ার কথা থাকলেও বরং আরও জটিল হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দেন না, বরং জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করেন। ভ্যাটের মৌলিক প্রিন্সিপাল হলো। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দেন না, তারা শুধু কালেক্টর। এটি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আরও জানান, আয়করে বড় ধরনের লিকেজ রয়েছে। রাজস্বের বড় অংশ আসা উচিত আয়কর থেকে, এরপর ভ্যাট আর কাস্টমস থেকে সবচেয়ে কম। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত হারে আদায় বাড়ছে না।
তিনি বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন। ৩২ বছর পরও ওই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। ব্যয় বেশি হলে, আয় কম হলে ঋণ বেড়ে যায়। এটা যেমন পরিবারের জন্য সত্য, দেশের জন্যও প্রযোজ্য। গতকাল এই বিষয়টি বলেছিলাম, কিন্তু মিডিয়ায় ভুলভাবে এসেছে। মূল কথা রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।’
আবদুর রহমান বলেন, ‘রাজস্ব বাড়ছে, তবে যে হারে বাড়ার কথা সেই পরিমাণে বাড়ছে না। টার্নওভার ৩ কোটি টাকা থেকে ৫০ লাখ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে ৫০ লাখ রেজিস্ট্রেশন হওয়ায় কথা। সেটা তো হয়নি। সব তথ্যই ব্যবসায়ীসংশ্লিষ্টদের কাছ আছে। কারা নেটের বাইরে রয়েছে। এখন অনেকে বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। কারণ দেশে তারা কর প্রশাসনের সহায়তা পায় না। যারা কর দেয়, তাদের যদি নার্সিং করতে না পারি, তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে না। রাজস্ব আহরণ হচ্ছে মধু আহরণের মতো। সে কারণে করদাতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাকে সোনার ডিম পারা হাঁসের মতো মেরে ফেললে তো হবে না। বিভিন্নভাবে হয়রানি বা জুলুম করা যাবে না।’
আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভ্যাটের বিরোধিতা শুরু থেকে ছিল। ভ্যাট আদায় যতটুকু হওয়ার কথা ছিল, সে তুলনায় পিছিয়ে আছি। তবে সম্ভাবনা রয়েছে। একদিকে ভোক্তাকে ভ্যাট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আদায় করে এনবিআরকে দিতে হবে। সেখানে কোনো ব্যত্যয় করা যাবে না।’
ভ্যাট না দিলে কী হবে, সে বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে বলে জানিয়েছেন এফআইসিসিআইয়েরর ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আজমান।
জাতীয় ভ্যাট দিবস পালিত
‘সময়মতো নিবন্ধন নিব, সঠিকভাবে ভ্যাট দিব’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে গতকাল জাতীয় ভ্যাট দিবস উদযাপিত হয়েছে। গতকাল থেকে ভ্যাট সপ্তাহ পালিত হচ্ছে।
ভ্যাট দিবসের পাশাপাশি ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ভ্যাট সপ্তাহ কর্মসূচি নিয়েছে এনবিআর।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ভ্যাট দিবসের গুরুত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী ১০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী বিশেষ নিবন্ধন ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে; যার উদ্দেশ্য হবে ১ লাখ নতুন ভ্যাট নিবন্ধন নিশ্চিত করা। বর্তমানে দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ লাখ ৪৪ হাজার। বিগত অর্থবছরে এনবিআর মোট আদায়ের ৩৮ শতাংশ ভ্যাট হতে আদায় করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছে।
এনবিআর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভ্যাট আদায় ব্যবস্থাপনা জোরদার করার মাধ্যমে ভ্যাটের আদায় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে দেশের আর্থিক বুনিয়াদ মজবুত করা সম্ভব। ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে নানামুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন অনিবন্ধিত ব্যবসা, পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের অভাব, রেয়াত-শৃঙ্খল কার্যকর না হওয়া, অতিরিক্ত অব্যাহতি, ম্যানুয়াল অডিট ব্যবস্থা, ই-কমার্স ও উদীয়মান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করতে না পারা প্রভৃতি।
একসময়ে বছরের ১০ জুলাই জাতীয় ভ্যাট দিবস পালিত হতো। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে মূসক প্রবর্তিত হওয়ার পর এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ২০১১ সাল থেকে দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। আর ২০১৩ সাল থেকে দিবসের পাশপাশি ১০-১৫ ডিসেম্বর ‘ভ্যাট সপ্তাহ’ উদযাপন করা হচ্ছে। ভ্যাট-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রচার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেশের সব মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে গ্রাহকদের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে। রেডিও, টেলিভিশন, প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মনোয়ারুল হক/
