সাতক্ষীরার জেলা জজ আদালতে বিচারকাজে ধীরগতি

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (৬ ডিসেম্বর) : সাতক্ষীরার জেলা জজ আদালতে ন্যায়বিচার পেতে মানুষের অপেক্ষা দিন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে। জেলার জনসংখ্যা, মামলার সংখ্যা এবং বিচারকাজের বিস্তৃতি যত দ্রুত বেড়েছে, আদালতব্যবস্থার কাঠামো ততটা বাড়েনি। জনবলসংকট, জায়গার ঘাটতি, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা ও নথি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা- এসব মিলিয়ে আদালতের প্রতিটি দিন হয়ে উঠছে বিচারপ্রার্থীদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। আদালত ভবনের পুরোনো কাঠামোর ওপর চাপ এতটাই বেড়েছে যে, ন্যায়বিচার পেতে মানুষের নিয়মিত সময় অপচয় এখন যেন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর সাতক্ষীরা আদালতব্যবস্থা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হলেও বাস্তবতার তুলনায় সেই সম্প্রসারণ এখন অনেকটাই পিছিয়ে আছে। বর্তমান সময়ে জেলা জজ আদালত ও তার অধীনে অন্যান্য আদালত মিলিয়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ১০৬টির মধ্যে ৪৩ হাজার ৮০৯টি সিভিল এবং ১৩ হাজার ২৯৭টি ফৌজদারি মামলা। বিচারকাজ সামলাতে আদালতের সংখ্যা মাত্র ১৭টি। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে ১৬টি আদালত গঠন করা হয়েছে। তবে যেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় এজলাস, দপ্তর, আসবাব, নথির কক্ষ কোনোটিই এখনো প্রস্তুত হয়নি। ফলে নতুন আদালতগুলো কার্যত নামেই স্থাপিত হয়েছে, চালুর উপযোগী নয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আদালত ভবনের তিনতলা ভবনের প্রতিটি কক্ষ এখন বিচার, দাপ্তরিক কাজ বা নথি সংরক্ষণের কাজে ভরাট হয়ে আছে। কোথাও ফাইল রাখার জায়গা নেই, কোথাও কর্মচারীরা নিজেদের ডেস্কে দাঁড়ানো অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। নথির স্তূপ ঠাসাঠাসি করে রাখা হওয়ায় হারিয়ে যাওয়া, ভুল জায়গায় চলে যাওয়া, সময়মতো খুঁজে না পাওয়া- এসব সমস্যা নিয়মিত ঘটছে।

আদাতল সূত্রে জানা যায়, আদালতের ১২৯টি অনুমোদিত পদের মধ্যে এখনো ৩২টি পদ শূন্য পড়ে আছে। যেসব কর্মচারী আছেন, তাদের একসঙ্গে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যুগ্ম জেলা জজ আদালত, দ্বিতীয় আদালত ও ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে কোনো স্থায়ী কর্মচারী নেই। ফলে আদালতের বিচারকরা প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করছেন, যা বিচারকাজকে আরও ধীর করছে।

আদালত চত্বরে সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকেই সাধারণ মানুষ নথিপত্র হাতে দপ্তর থেকে দপ্তরে ছুটে বেড়াচ্ছেন। স্থান-সংকুলান না হওয়ায় কেউ বারান্দায়, কেউ সিঁড়ির ধাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে সেবাপ্রত্যাশী হাজারও মানুষের।
আশাশুনি উপজেলার কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একটা মামলার তারিখ জানতে এলেও অর্ধেক দিন চলে যায়। কক্ষ কম, কর্মচারী কম আর ভিড় তো লেগেই আছে।’ শ্যামনগর উপজেলার গৃহবধূ রোকসানা খাতুন বলেন, ‘নথি জমা দিতে গেলেও জায়গা পাওয়া যায় না। সব সময় মনে হয় চাপের মধ্যে আছি।’

জেলা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ‘তিনতলা ভবনের প্রতিটি কক্ষ আমরা ব্যবহার করে ফেলেছি। নতুন ১৬টি আদালত চালু করা প্রায় অসম্ভব। কারণ জায়গা নেই। ভবন সম্প্রসারণ ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই।’

সাতক্ষীরা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) শেখ আব্দুস সাত্তার মনে করেন, সাতক্ষীরাবাসীর দাবিতে নতুন আদালত গঠন হয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামো না থাকলে এগুলো বাস্তবে চালানো যাবে না। বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমাতে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

আদালতের আইনজীবীদের অভিমত, ‘শুধু নতুন ভবন নয়, আদালতব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ আধুনিকায়ন করা জরুরি। নথি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল হলে ভুল কমবে, ঠিক সময়ে বিচার পাওয়া সহজ হবে। জনবলসংকট কাটানো এবং আদালত পরিচালনার নিয়মকানুন আধুনিকায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরায় দ্রুত মামলা বাড়ছে। কিন্তু আদালতের সক্ষমতা সেই হারে বাড়েনি। ফলে মামলার নিষ্পত্তির গতি কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, ২২ লাখের বেশি জনসংখ্যার এ জেলার মানুষকে প্রতিদিনই ভরসা করতে হয় আদালতের ওপর। কিন্তু অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও জনবলসংকট ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকারকেই হুমকির মুখে ফেলছে। এ জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মচারী নিয়োগ, নতুন আদালতের জন্য পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো ও আদালতের আধুনিকায়ন ছাড়া এই সংকট কাটানোর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই।

মনোয়ারুল হক/

 

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ