বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ, ক্ষুব্ধ গ্রাহক

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১৮নভেম্বর) : সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ জনসেবা বন্ধের সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই তো বাংলাদেশ ব্যাংক এই সেবাগুলো দিয়ে আসছে। তাহলে এখন কেন বন্ধ করে দেবে? এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্বিঘ্নে এই সেবাগুলো পাওয়া গেলেও অন্য কোনো ব্যাংকে এত সুন্দরভাবে এই সেবাগুলো পাওয়া যায় না।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড বিক্রি, ছেঁড়া-ফাটা নোট বদল, সরকারি চালানের টাকা জমা দেওয়া ও চালানসংক্রান্ত ভাংতি টাকা দেওয়ার কাজ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মৌখিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৩০ নভেম্বরের পর মতিঝিল কার্যালয় থেকে আর এসব সেবা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা জোরদার ও ক্যাশ বিভাগ আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে মতিঝিল কার্যালয়ের এসব সেবা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচেই সংস্থাটির মতিঝিল কার্যালয়। ১৯৮৫ সাল থেকে এই কার্যালয় এসব সেবা দিয়ে আসছে। মতিঝিল কার্যালয় থেকে এসব সেবা বন্ধ হয়ে গেলে এসব সেবা নিতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। এতে ভোগান্তি বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা।

গতকাল বংশাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কিনতে আসা গ্রাহক তাসলিমা আকতার বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র কিনলে টাকা জমা হতে প্রায় এক মাস সময় লাগে।’ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংক থেকে একবার সঞ্চয়পত্র কেনার পর এক মাস লাগে টাকা জমা হতে। এরপর তিনি জিপিও থেকে কেনেন। সেখানে দালাল ছাড়া কাজ হয় না। ২০০ বা ৫০০ টাকা দালালকে দিয়ে এটা করানো লাগে। এখানেও সময় লাগে ৭-১০ দিন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে এক দিনের মধ্যেই টাকা জমা হয়ে যায়।’ একই সময়ে বেশকিছু ছেঁড়া-ফাটা টাকা পরিবর্তন করতে আসা গ্রাহক মোসলেউদ্দিন বলেন, ‘গোপীবাগে আমার মুদি দোকান রয়েছে। সেখানে অধিকাংশ গ্রাহকই ছেঁড়া-ফাটা নোট নিয়ে আসেন কেনাকাটা করতে। নিতে না চাইলে তারা বলেন, বাজারে নতুন নোট না থাকলে আমরা কোথায় পাব? ফলে বাধ্য হয়ে তাদের কাছ থেকে ছেঁড়া-ফাটা নোট রাখতে হয়, যা অন্য কোনো ব্যাংকে পরিবর্তন করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেই আসতে হয়। এখন এসব সেবা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তো আমার মতো অনেকেই বিপদে পড়বেন।’

অন্য এক গ্রাহক নাসিমা খাতুন বলেন, ‘শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংক জন্মলগ্ন থেকেই এসব সেবা দিয়ে আসছে। এতদিন যদি নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে এখন কেন হবে? এসব সেবা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমার মতো অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান গভর্নর যোগদানের পর থেকেই এসব সেবা বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সম্প্রতি জালিয়াত চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ‘এনএসসি সিস্টেমে’ অনুপ্রবেশ করে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তড়িঘড়ি করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তারা বলেন, ‘জালিয়াত চক্র সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর টাকা বেসরকারি একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করে। ব্যাংকের যে শাখায় স্থানান্তর করা হয়, একই ব্যাংকের আরেক শাখা থেকে তা তুলে নেওয়া হয়। অর্থ তুলে নেওয়ার পর বিষয়টি ধরা পড়লে সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে মতিঝিল থানায় মামলাও করেছে।’

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই গভর্নর যোগদানের পর থেকেই এসব সেবা বন্ধ করার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে জালিয়াতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গভর্নর মৌখিকভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগেও একবার সঞ্চয়পত্রের সেবাটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরিয়ে সোনালী ব্যাংকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর বাধ্য হয়ে আবার সেটি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘এই সেবাগুলো যেন গ্রাহকরা অন্য ব্যাংক থেকে নির্বিঘ্নে পান, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই সেবা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে গ্রাহকের ভোগান্তি বাড়বে। কেননা অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, যেকোনো সেবা পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ থাকে। তাই এমন অভিযোগ যেন না থাকে আগে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেবল নির্দেশনা দিলেই হবে না, তারা যেন সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে, সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা কার্যালয় থেকে এ ধরনের সব সেবা বন্ধ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি হলে তাতে সাধারণ মানুষকে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সেবার ইতি ঘটবে। তার বদলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তদারকিতে বেশি মনোযোগী হবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা কার্যালয় থেকে সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড কেনাবেচাসহ ১০ ধরনের সেবা দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব সেবা দিয়ে আসছে। বর্তমানে মতিঝিল কার্যালয়ের ২৮টি কাউন্টারের মাধ্যমে এসব সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আপাতত পাঁচটি সেবা দেওয়া ১২টি কাউন্টার ৩০ নভেম্বরের পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে, আগামী ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে নগদ টাকায় সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড কেনাবেচা হবে না। সরকারের পক্ষে ট্রেজারি চালানও জমা নেওয়া হবে না। পাশাপাশি ভাংতি টাকা এবং ছেঁড়া-ফাটা নোট বদলের সেবাও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে মতিঝিল কার্যালয়ের ১৬টি কাউন্টারে কিছু সেবা মিলবে। এগুলো হলো ধাতব মুদ্রা বিনিময়, স্মারক মুদ্রা বিক্রয়, অপ্রচলিত নোট বিরোধ নিষ্পত্তি, ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন প্রভৃতি। ধীরে ধীরে এসব সেবাও বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ