ফিলিস্তিনিরা ভূখণ্ড ছাড়বে না: মাহমুদ আব্বাস
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ, (২৬ সেপ্টেম্বর) : ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিরা তাদের মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাদের জনগণ নিজেদের শেকড় আঁকড়ে ধরে রাখবে। বার্তায় কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ভূ-খণ্ড ছাড়ব না।’
বৃহস্পতিবার (২৫ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভার্চুয়ালি দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি গাজা ও পশ্চিম তীরে দখলদারত্বের অবসান ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করেন। ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসন, অব্যাহত গণহত্যা, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ ও দখলদারত্বের তীব্র নিন্দা জানান।
এদিকে বিশ্ব নেতাদের চাপে অবশেষে পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদন সার স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত কোনো অঞ্চল সংযুক্ত করার বা দখল করার পরিকল্পনা নেই ইসরায়েলের। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপেই এই অবস্থান বদলেছে নেতানিয়াহুর প্রশাসন।
জাতিসংঘে ভাষণে আব্বাস বলেন, ‘চরমপন্থি ইসরায়েলি সরকার পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ ও দখলদারত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ‘ই-ওয়ান’ বসতি পরিকল্পনা পশ্চিম তীরকে দ্বিখণ্ডিত করবে, জেরুজালেমকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথ বন্ধ করে দেবে। তিনি এটিকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ পরিকল্পনা ও কাতারের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে আব্বাস বলেন, ‘আমরা এসব বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর ভয়াবহ আঘাত এবং আন্তর্জাতিক আইনের ঘোরতর লঙ্ঘন।’
বক্তব্যের শেষে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘আমরা আমাদের ভূমি ছাড়ব না, ফিলিস্তিনিরা এই মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না।
প্রায় দুই বছর ধরে গাজা উপত্যকায় গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, অনাহার ও বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ পরিস্থিতি চললেও ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের ক্ষত যতই গভীর হোক, যতই এই দুঃসহ সময় দীর্ঘ হোক, তা আমাদের বাঁচার ও টিকে থাকার ইচ্ছা ভাঙতে পারবে না। স্বাধীনতার ভোর আসবেই। ফিলিস্তিনের পতাকা আমাদের আকাশে উড়বে। জেরুজালেম আমাদের হৃদয়ের রত্ন এবং আমাদের চিরন্তন রাজধানী। আমরা আমাদের পবিত্র ভূমি ত্যাগ করব না, আমাদের মানুষ অলিভ গাছের মতো শেকড় গেঁথে থাকবে।’
এদিকে সম্প্রতি ইতালির দৈনিক ‘কোরিয়েরে দেলা সেরা’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গিদন সার বলেন, ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত কোনো এলাকা দখলের আলোচনা আমাদের মধ্যে নেই। আমরা ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না।’ তবে তিনি জানান, যেসব ইসরায়েলি বসতি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে নেই, সেখানে ইসরায়েলি আইন প্রয়োগ করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন। তিনি দেশে ফেরার পর এই বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
ইসরায়েলকে পশ্চিম তীর দখল করতে দেওয়া হবে না: ট্রাম্প
এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েলকে পশ্চিম তীর দখল করতে দেওয়া হবে না। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সৌদি আরব, মিসর, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, জর্ডান ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ, গাজা দখল ও জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা হয়। ট্রাম্প সব বিষয়ে ‘ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া’ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপস্থিত এক কর্মকর্তা।
ইসরায়েলের পশ্চিম তীর অধিগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে: মাখোঁ
ইসরায়েল পশ্চিম তীরের কোনো অংশকে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নিতে চাইলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়াবে। এটি আরব-ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের অবসান ঘটাবে। গত বুধবার এ মন্তব্যগুলো করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। তিনি আরও জানিয়েছেন, এ রকম হবে না বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন ট্রাম্প।
মাখোঁ জানান, তিনি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত তিন পাতার পরিকল্পনা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতাকে। ওই পরিকল্পনা নিউইয়র্ক ঘোষণার ভিত্তিতে করা, যাতে বিশ্বের ১৪৩টি দেশের সমর্থন রয়েছে। প্রস্তাবে গাজা ও পশ্চিম তীরের শাসনব্যবস্থা থেকে হামাসকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ফ্রান্স ২৪-এ মাখোঁ বলেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও আরব রাষ্ট্রগুলোকে এক সমঝোতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে তার গত মঙ্গলবার বৈঠক হয়েছে। ইসরায়েলের পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট শর্তেই ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা একমত।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েল পশ্চিম তীরে আরও বসতি বাড়াতে চাইছে। এর মধ্যে ই১ নামে একটি করিডর তৈরি করতে চাইছে তারা। সেটির অধীনে ৩ হাজার ৪০০টি নতুন বাড়ি থাকবে। মূলত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের দ্বিরাষ্ট্র সমাধানে বাগড়া দিতেই ওই পরিকল্পনা করেছে তারা। ইসরায়েল আদৌ এটি করতে সক্ষম হলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
মাখোঁ আরও বলেন, পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা আব্রাহাম চুক্তিরও অবসান ঘটাবে। ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ওই চুক্তিটি করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বাড়ালে যে ওই চুক্তি আর থাকবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি মনে করি এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শেষ সীমা।’
গাজার যুদ্ধ অবসানের পর ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে বা দরজার ওপাশে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাই বা কী চলছে, সেগুলোর একটি স্পষ্ট ধারণা মিলেছে মাখোঁর এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ও বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিল। ওই আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতও ছিল। ট্রাম্প প্রশাসন সে সময় বেশ ফলাও করে নিজেদের সফলতার গল্প প্রচার করেছিল। এটি ব্যর্থ হয়ে গেলে তা আখেরে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
পশ্চিম তীর নিয়ে ইসরায়েলকে কড়া হুঁশিয়ারি ফ্রান্স ও সৌদি আরবের
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈশ্বিক সম্মেলনে ফ্রান্স, সৌদি আরবসহ ১৫৬টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত সোমবার আয়োজিত সম্মেলনের যৌথ ঘোষণায় ফ্রান্স ও সৌদি আরব হুঁশিয়ারি দেয় পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের যেকোনো সম্প্রসারণ হবে ‘রেড লাইন’। তারা বলেছে, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের যেকোনো সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিচুক্তি ও স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। একই সঙ্গে তারা গাজায় যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিতকরণ এবং ইসরায়েলি কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখোঁ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা চাই গাজা ও পশ্চিম তীরে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠুক, যেখানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে।’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ বিরোধ নিরসনের সূচনা হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন ওই সময় চুক্তিটিকে নিজেদের বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরেছিল। কিন্তু পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন হয়, তবে সেই চুক্তির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্বব্যাপী এই সমর্থন এবং ইসরায়েলের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক অবস্থান একটি নতুন কূটনৈতিক চিত্রের জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে গাজায় চলমান সহিংসতা, পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই চাপ অব্যাহত থাকলে ইসরায়েল হয়তো পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাতিল করতে বাধ্য হবে।