ইলিশের বড় বিচরণক্ষেত্র মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় নিষেধাজ্ঞার মাঝেই জাটকা আহরণ
নিজস্ব প্রতিবেদক (বরিশাল), এবিসিনিউজবিডি, (৭ নভেম্বর) : দশ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের ইলিশকে বলা হয় জাটকা। ইলিশের প্রজনন ও বেড়ে ওঠা নির্বিঘ্ন করতে বছরের বিভিন্ন সময় সাগর ও নদ-নদীতে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। সর্বশেষ ৪-২৫ অক্টোবর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। জাতীয় এ মাছের উৎপাদন বাড়াতে ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ১ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে জাটকা ধরায় আট মাসের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের সব নদ-নদী ও উপকূলীয় সাগর অঞ্চলে এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। তবে নিষেধাজ্ঞার মাঝেই বরিশালে ইলিশের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে জাটকা আহরণ করছেন কিছু জেলে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৩ সাল থেকে সরকার ধাপে ধাপে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বরিশাল বিভাগে ইলিশ উৎপাদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বর্তমানে দেশের মোট ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশই আসে এ অঞ্চলের নদ-নদী থেকে। তবে এভাবে জাটকা আহরণ করলে ইলিশের সংকট দেখা দিতে পারে।
স্থানীয়রা বলছেন, বরিশাল নগরের প্রধান মৎস্য মোকাম পোর্ট রোড ও এনায়েতুর রহমান সড়কের সংযোগস্থলে কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা প্রায় প্রতিদিনই জাটকা বিক্রি করেন। ৪০০-৫৫০ টাকায় এক কেজি কিনলে ১০-১২ পিস পাওয়া যায়। শুধু পোর্ট রোড নয়, নগরের সর্বত্র প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রি হচ্ছে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি হিজলা উপজেলার সভাপতি জাকির হোসেন মঙ্গলবার দুপুরে গৌরবদী ইউনিয়নের ফরহাদের মাছঘাটে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, শত শত জেলে মেঘনায় জাল ফেলে জাটকা আহরণ করছেন। প্রতিবারে জাল ফেলে কমপক্ষে ৮০ পিস পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো আকারভেদে বিক্রি প্রতি পণ (৮০ পিস) ৮০০-১২০০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি পিস জাটকার দাম পড়ছে ১০-১৫ টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এসব জাটকা ৭০০-৯০০ গ্রাম ওজন হতো। এভাবে জাটকা নিধন করায় প্রতি বছর ভরা মৌসুমে নদীতে ইলিশ সংকটে পড়তে হয়।
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগরের নোনা পানি ছেড়ে মিঠাপানিতে এসে ডিম ছাড়ে। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা এবং ভোলা জেলাসংলগ্ন মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী হলো জাটকার বিচরণ ক্ষেত্র। মেঘনার অন্য প্রান্তে শরীয়তপুর, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর একাংশ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব জেলার মেঘনা তীরের প্রভাবশালীরা ইলিশঘাটের মালিক। তাদের ছত্রছায়ায় জেলেরা প্রতিদিন জাটকা আহরণ করছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনা তীরে জাটকার পাইকারি বড় মোকাম হলো মাদারীপুরের কালকিনী উপজেলার মিয়ারহাট। এছাড়া শরীয়তপুরের ঘোষেরহাট, ভোলার রেহানউদ্দিনের মাছঘাট, পট্টিবাজার, বরিশাল ও শরীয়তপুরের সীমানায় খোকা ব্যাপারীর মাছঘাটসহ ছোটবড় আরো কিছু মোকাম রয়েছে। বরিশাল ও ভোলার মেঘনা, তেঁতুলিয়াসহ অন্যান্য শাখা নদীতে আহরিত জাটকা ট্রলারে এনে এসব মোকামে পাইকারি বিক্রি হয়। সেখান থেকে সড়ক ও নৌপথে সারা দেশে বাজারজাত হচ্ছে। পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া, আগুনমুখা নদীসহ মোহনায় নিধন করা জাটকা বিক্রি হয় গলাচিপার পানপট্টি, লঞ্চঘাটসহ কমপক্ষে ১০টি পয়েন্ট ও কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুর মোকামে। বরিশাল নগরীসংলগ্ন তালতলী বাজারেও পাইকারি বিক্রি হয় জাটকা। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে ছড়িয়ে পড়েন নগরীতে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৮০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়ে আশ্বিনের পূর্ণিমায়। প্রজনন নিরাপদ করতে প্রতি বছর আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পরে ২২ দিন ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘যদি সত্যিই উৎপাদন বাড়ত, তাহলে বাজারে ইলিশের সরবরাহও বাড়ত। কয়েক বছর ধরে দেশে ইলিশ সংকট চলছে। তাছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর যে হিসাব দেখাচ্ছে তাতে বছরে ইলিশ বৃদ্ধির হার দশমিক ১৬ শতাংশ। অথচ ইলিশ সংরক্ষণে সরকারের ব্যয় বাড়ছে বছরে ১০ শতাংশ। সরকারের ব্যয় ও উৎপাদনের মধ্যে ফারাক রয়েছে।’
জাটকা নিধন প্রসঙ্গে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক জহিরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘স্বল্প জনবল দিয়ে বিশাল নদ-নদী পাহারা দেয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। মেঘনা ও এর শাখা নদীতে জাটকা নিধনের বিষয়টি আমরাও শুনেছি। অভিযানে কিছু জাল জব্দও হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মঙ্গলবার হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদী পর্যবেক্ষণে গিয়েছিলেন। শিগগিরই নদীতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
