জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবটি ‘অসাংবিধানিক’

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১ নভেম্বর) : জুলাই সনদের সাংবিধানিক সংস্কারগুলো ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়িত না হলে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে—জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এমন সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করেছেন কিছু আইন বিশেষজ্ঞ।

তারা এমন প্রস্তাবকে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এর কোনো নজির নেই এবং এটি আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

গত ২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে জুলাই সনদ নিয়ে প্রস্তাবিত গণভোট ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের দিনই হবে নাকি তার আগেই অনুষ্ঠিত হবে, নেই সিদ্ধান্ত সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সেখানে দুটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, প্রস্তাব দুটির মূলভাব একই। সরকার জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি করবে; সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংসদ গঠিত হবে; এবং সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, যার সাংবিধানিক বিষয়ে ‘মূল ক্ষমতা’ প্রয়োগের অধিকার থাকবে।

প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, গণভোটে যে প্রশ্ন থাকবে তার সঙ্গে আদেশের একটি সূচিতে সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সনদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি সংবিধান সংস্কার খসড়া বিল প্রণয়ন করে তা আদেশের সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম বৈঠকের ২৭০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হলে, ওই সংস্কারগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

বাস্তবায়ন আদেশটি রাষ্ট্রপতি নাকি প্রধান উপদেষ্টা জারি করবেন, এই কঠিন প্রশ্নটিও কমিশন সরকারের ওপরই ছেড়ে দিয়েছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশটি সাংবিধানিক কি না—এমন প্রশ্নে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বিশ্বে আইনের ইতিহাসে এমন কোনো আদেশের নজির নেই।

তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান আমলে সংবিধান স্থগিত থাকাকালে সামরিক শাসকরা এমন ধরনের আদেশ জারি করতেন।

ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও গণভোটের জন্য একটি বিল প্রস্তুতের পাশাপাশি এমন একটি বিধান থাকবে যে, পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, ‘আইনের ইতিহাসে অনেক নতুন উদ্ভাবন হয়েছে, কিন্তু এমন কিছু আগে কখনো শোনা যায়নি। আমরা এমন অভিনব কাজ করছি, যার কারণে পুরো বিশ্ব আমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। আমরা এখন বিশ্বকে নতুন আইন শেখাচ্ছি।’

২৭০ দিনের এমন সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি ভবিষ্যৎ কোনো সংসদকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করতে পারেন না। সংসদ কোনো আইন করতে পারে। কিন্তু বলতে পারে না যে পরবর্তী তিনটি সংসদ সেই আইন বদলাতে পারবে না। আইনের কার্যপদ্ধতি এভাবে চলে না।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি সংসদই সার্বভৌম। বর্তমান সংসদ কোনো আইন পাস করতে পারে বা না-ও করতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যৎ সংসদকে কী করতে হবে বা কী করা যাবে না, সেটা নির্ধারণ করে দিতে পারে না। অথচ এখন বলা হচ্ছে, ২৭০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত না হলে বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত বলে গণ্য হবে। ফলাফল যদি আগেই নির্ধারিত থাকে, তাহলে ২৭০ দিনের আলোচনা রাখারই বা দরকার কী?’

তিনি আরও বলেন, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাবসহ কিছু বিধান বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘যদি কোনো আইন বইয়ের একটি অংশে এক কথা লেখা থাকে, আর অন্য কোনো অংশে বিপরীত কথা লেখা থাকে, তাহলে সেটা কী গ্রহণযোগ্য হয়?’

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, সংবিধানে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন বা ২৭০ দিনের মধ্যে বিল পাসের কোনো বিধান নেই।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিধান। এটা নিয়ে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এমন কোনো বিধান আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।’

তিনি বলেন, সংসদ না থাকলে অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রপতির। ‘অধ্যাদেশ জারি হলে তা ৩০ দিনের মধ্যে সংসদে পেশ করতে হয়। সংসদ যদি ৩০ দিনের মধ্যে তা পাস না করে, তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়।’

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘তারা কেন এমন বিকল্প রাখার কথা ভেবেছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। এটা অসাংবিধানিক।’

সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে এটা অনুমোদন বা আপত্তি জানানোর জন্য ১৫ দিন সময় থাকে। ওই সময়ের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বিলটি গৃহীত বলে গণ্য হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, ‘আদেশের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের প্রস্তাবগুলো গুরুতর সাংবিধানিক ও প্রক্রিয়াগত উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।’

তিনি বলেন, ‘যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, আজকের বাংলাদেশ এখনো এক সাংবিধানিক গণতন্ত্র। এই মৌলিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কোনো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থার বৈধতাকে বিপন্ন করতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গণভোট সরাসরি গণতন্ত্রের একটি উপায় হতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন স্পষ্ট ও একক ইস্যু এবং জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ। কিন্তু জুলাই সনদে বহু জটিল বিষয় রয়েছে। সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই বিভক্তি আছে। আরও গুরুতর বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নেই।’

রাশনা ইমামের মতে, ‘বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর জমা দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমন অবহেলার ফলে কমিশনের কার্যক্রমের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হয়।’

তিনি বলেন, ‘কমিশনের বর্তমান গতিপথ জনআস্থা ও বিদ্যমান সাংবিধানিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষয় করছে। জুলাই সনদ যদি সত্যিকারের জাতীয় পুনর্গঠনের হাতিয়ার হতে চায়, তাহলে এর বাস্তবায়ন হতে হবে সর্বজনীন রাজনৈতিক ঐকমত্য, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে। কোনো শর্টকাট বা চাপিয়ে দেওয়া প্রক্রিয়ায় সেটা হতে পারবে না।’

ঐকমত্য কমিশনকে পরামর্শ দেওয়া আইন বিশেষজ্ঞদের একজন ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কয়েকটি দেশে এমন বিধান আছে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে তাদের গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। সময়মতো কাজ শেষ করা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এটা এক ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাখা হয়।’

তিনি বলেন, ‘অবশ্য, আমাদের প্রেক্ষাপটে এই ব্যবস্থা উপযুক্ত না। কারণ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে সংসদ ভেঙে দিলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। আবার কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকলে রাজনৈতিক পক্ষগুলো সংস্কারে দেরি করতে পারে বা এড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই কারণেই ঐকমত্য কমিশন একটি মধ্যপন্থা প্রস্তাব করেছে যে, সংস্কার সময়মতো শেষ করতে না পারলে সেগুলো গৃহীত বলে গণ্য হবে।’

সৌজন্যে: দ্য ডেইলি স্টার

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ