রাজধানীর বাসে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না ?

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: কিছু শর্ত পূরণের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে ‘সিটিং সার্ভিস’ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষেই পরামর্শ দিয়েছে এই বিষয়ে গঠিত কমিটি। শর্তের মধ্যে আছে রাজধানীতে চলাচলকারী সব পরিবহনকে কিছু কোম্পানির অধীনে পরিচালনা করতে হবে। কোম্পানির কিছু বাস সিটিং আর কিছু হবে লোকাল। দুই শ্রেণির বাসের রং হতে হবে আলাদা। সিটিং সার্ভিসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না, স্টপেজ থাকবে কম।
গত বুধবার কমিটি ২৬ দফা সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। তবে গত এপ্রিল মাসে সিটিং সার্ভিস বন্ধে অভিযান শুরুর পর যেসব পরিবহনমালিক বাস বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনার বিষয়ে কমিটি কোনো সুপারিশ করেনি। অথচ যে বৈঠকে এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেখানে বিআরটিএর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বাস বন্ধ রাখা মালিকদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোটরযান আইনে বাস-মিনিবাসের চলাচল বন্ধ রাখতে হলে কর্তৃপক্ষকে আগে থেকে জানানোর নিয়ম। আর হঠাৎ নষ্ট হলে সেটাও জানানোর কথা। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা অনুমতির শর্ত লঙ্ঘন করবে। এর সর্বোচ্চ শাস্তি যানবাহনের অনুমতি বাতিল।
কিন্তু অতীতে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা পুলিশের বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে মোটরযান আইন প্রয়োগ করতে গেলে বাস বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এ জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়ার নজির নেই।
সুপারিশ কমিটির প্রতিবেদনে সিটিং সার্ভিস ও লোকাল বাসের ভাড়ার হার ঠিক করা এবং তা কীভাবে কার্যকর করা হবে—এই বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়নি। কমিটি ভাড়া-নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি ও একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধে বেসরকারি মালিকদের অনুমতি বন্ধ রেখে বিআরটিসির দ্বিতল বাস বেশি করে চালুর পরামর্শ দিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এই প্রতিবেদনে সিটিং সার্ভিসের নামে যে নৈরাজ্য চলছে, এর বৈধতা পেয়ে যাবে। কারণ নির্ধারিত ভাড়ার হার সরকার কোনো দিনই কার্যকর করতে পারেনি। আগে এটা নিশ্চিত করার নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। এ ছাড়া প্রতিটি বাস ২০ শতাংশ আসন খালি নিয়ে চলবে—এমনটা ধরেই ভাড়া ঠিক করা হয়েছে। ফলে আলাদা করে সিটিং সার্ভিস চালু রাখা ও আলাদা ভাড়া নির্ধারণ অযৌক্তিক। এর ফলে যাত্রী অধিকার রক্ষিত হবে না। বাস বন্ধ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী মালিকের শাস্তি না হলে ভবিষ্যতেও তাঁরা কোনো নির্দেশ মানবেন না।
গত ১৬ এপ্রিল হঠাৎ করে সিটিং সার্ভিস বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পরিবহন মালিক সমিতি ও পুলিশ অভিযান শুরু করে। এ সময় পরিবহনমালিকেরা প্রায় ৪০ শতাংশ বাস বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এরপর সিটিং সার্ভিস পুনরায় চালু করে এই বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে বিআরটিএ, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক প্রতিনিধি ও পুলিশের সমন্বয়ে আট সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা চারটি বৈঠক করেন। বিআরটিএর ওয়েবসাইটে মতামত/পরামর্শ আহ্বান করলে ২০৫ জন এতে সাড়া দেন।
এসব বিষয়ে কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, তাঁরা মোটাদাগে গণপরিবহনকে উৎসাহিত করা এবং এই খাতে শৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়েছেন। আইনি নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে এর কঠোর প্রয়োগ করার দায়িত্ব সরকারের। মালিকদের শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, কমিটির কার্যপরিধিতে মালিকদের শাস্তির বিষয়টি ছিল না।

লোকাল বাস
কমিটি লোকাল বাসকে কোনো অবস্থাতেই সিটিং সার্ভিস হিসেবে ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু লোকাল বাসে বাদুড়ঝোলা করে যাত্রী পরিবহন বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেই বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেনি। শুধু সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাস বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।
অথচ গণপরিবহনের অনুমতির শর্তে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময় বা মৌসুম এবং নির্দিষ্ট যানবাহন বাদে সব বাস-মিনিবাসে নির্ধারিত আসনের অধিক যাত্রী বহন করা যাবে না। তবে নিবন্ধনের শর্তের মধ্যে বলা আছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ চাইলে ১০ জন যাত্রী দাঁড় করিয়ে নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বাসের মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা কমপক্ষে ছয় ফুট হতে হবে। আর মাঝখানের পথটি ১৮ ইঞ্চি চওড়া হতে হবে। বিআরটিএর সূত্র বলছে, ঢাকার কোনো মিনিবাসই এত উঁচু নয়।
এসব আইন কঠোরভাবে পালনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।

উন্নত বাসসেবার পরামর্শ
ঢাকায় এখন বাস চলে প্রায় ছয় হাজার। আর পরিবহনমালিকের সংখ্যা দুই হাজারের কাছাকাছি। এই ব্যবস্থা বদলানোর পরামর্শ এসেছে। এই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক একটি উদ্যোগ বেশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকায় এর কোনো অগ্রগতি নেই।
সিটিং সার্ভিস-সংক্রান্ত কমিটি ঢাকায় পর্যাপ্ত এসি বাস নামানোর সুপারিশ করেছে। এর জন্য আলাদা ভাড়া নির্ধারণের কথাও বলেছে। এ ছাড়া বাস ভ্রমণে ট্রাভেল কার্ড ও ই-টিকেটিং চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এই বিষয়ে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার একটি প্রকল্প চলমান আছে। গণপরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাখা চালু রাখা, বাস সর্বদা দৃষ্টিনন্দন রাখা, আসনব্যবস্থা মানসম্মত রাখা ও জানালায় পর্দা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্কুল-কলেজের জন্য নিজস্ব বাসসেবা চালু এবং নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের জন্য বরাদ্দ করা আসন নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিটি।

পরিবহনশ্রমিকদের নির্দেশনা
গণপরিবহনের চালক ও সহকারীদের পোশাক নির্ধারিত করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁদের জন্য পরিচয়পত্রও বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে। স্টপেজ ব্যতীত রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ করার পাশাপাশি স্টপেজে একসঙ্গে একাধিক বাস দাঁড় না করানোর পরামর্শ আছে।
জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রী এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন। তবে নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাঁরা ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ, রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি বন্ধে অভিযান চালাচ্ছেন। এটি আরও জোরদার করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ