কাতারের ওপর অবরোধ কি ব্যর্থ হচ্ছে ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গত জুনের শুরুর দিকে কাতারের ওপর যখন অবরোধ আরোপ করা হয়, তখন সেটি ছিল বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত খবর। এমনকি সাময়িকভাবে ব্যাপক সমস্যাতেও পড়েছিল দোহা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছিল দেশটির অর্থনীতি। আর সেই চাপকে কাজে লাগিয়ে কাতারকে শর্তের বেড়াজালে আটকে ফেলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ওই দুই দেশের নেতৃত্বে কাতারকে কোণঠাসা করার সব আয়োজনই শেষ হয়েছিল। কিন্তু মাস দেড়েক পর দেখা যাচ্ছে, সেই অবরোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে কাতার।

ওই সময় সৌদি আরবসহ সাতটি দেশ কাতারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে। তাদের অভিযোগ, দেশটি সন্ত্রাসবাদে আর্থিক সহায়তা ও মদদ দিয়ে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। তবে দোহা কর্তৃপক্ষ বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এর পর নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচতে কাতারের ওপর ১৩টি শর্ত মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া হয়। অবস্থা এমন ছিল, যেন অবাধ্য সন্তানকে পিটিয়ে শায়েস্তা করা হচ্ছে!

কিন্তু বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সৌদি ও আরব আমিরাতের নেতৃত্বে আরোপ করা অবরোধ দোহাকে কাবু করতে পারছে না। যে উদ্দেশ্যে এই অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল, সেটিও থাকছে নাগালের বাইরে। কাতারকে আঞ্চলিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার বদলে এই অবরোধ উল্টো তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। ওমান ও কুয়েতও অবরোধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি। কাতারের বন্দর ও বিমানবন্দরে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের সরবরাহে এখনো উল্লেখযোগ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়নি। হোয়াইট হাউস এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তবে তাতে কাতারের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা বরং সৌদি ও আমিরাতের দাবির দিকে কম পাত্তা দিয়ে, জোর দিচ্ছে কাতারের সঙ্গে মিটমাট ও আপসের প্রতি।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্ক লিঞ্চ বলেন, ‘ইয়েমেনে সর্বনাশা এক যুদ্ধের পর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সাফল্যের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু তা করতে গিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে বিকল্প পরিকল্পনা লাগে। আর সেটি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। বিশেষ করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি থেকে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করে সফল হতে চেয়েছিল বিরোধী চারটি দেশ। কিন্তু তা কাজে দেয়নি। প্রতিবেশীর ক্ষতি করার ব্যাপারে নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কেও তাদের ধারণা ভুল ছিল।’

চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্টে অবরোধকারীদের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, গত মে মাসের শেষের দিকে কাতারের সরকারি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাক করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। ওই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছিল যে, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি ইরানকে ‘ইসলামি শক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং ফিলিস্তিনের হামাস গোষ্ঠীর প্রশংসা করেছেন। অথচ এটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা! আর এ থেকেই সংকটের শুরু।

দোহা উচ্চকণ্ঠে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। কিন্তু তারপরও অটল থাকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। কাতারের সংবাদমাধ্যমকে প্রথমে নিষিদ্ধ করে এই দেশগুলো। পরে দোহার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে একঘরে করে ফেলে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলেছে, ‘গত সপ্তাহে কাতারে হ্যাকিংয়ের ঘটনার পক্ষে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২৩ মে তারিখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারা কাতারে হ্যাকিং চালানোর ব্যাপারে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। কীভাবে এই কাজটি করা হবে—তাও ঠিক করা হয়।’ তবে হ্যাকিংয়ের ঘটনা আরব আমিরাত নিজে করেছে নাকি অন্য কোনো ভাড়াটে সংস্থাকে দিয়ে করিয়েছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল-ওতাইবা এসব দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হ্যাকিংয়ের যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, তাতে আমার দেশের কোনো ভূমিকা নেই। কাতারের আচরণে সমস্যা আছে। তারা তালেবান থেকে শুরু করে হামাস পর্যন্ত সবাইকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কাতার মৌলবাদে উৎসাহ দিচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করছে।’

কাতার নিয়ে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর নজির আগেও পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে একটি খবর রটেছিল যে, লন্ডনে কাতারের মালিকানাধীন একটি দোকানে সৌদি ও আমিরাতের নাগরিকদের ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সেটি ছিল মিথ্যা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধের সূত্র ধরেই বর্তমান টানাপোড়েনের সূচনা। কাতারের ধনী ব্যক্তিরা যেভাবে আঞ্চলিক বিরোধ ও রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন, তা প্রতিবেশী দেশগুলোর পছন্দ হচ্ছে না। বিশেষ করে সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুতে কাতারের ভূমিকা ভালো চোখে দেখেনি কোনো প্রতিবেশী। আর তাই দেশটির প্রধান সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে রিয়াদ ও আবুধাবি।

নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ডেকলান ওয়ালশ বলেন, ‘আঞ্চলিক রাজনীতি ও সংঘাতে একটি নিরপেক্ষ মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কাতার। বিবদমান সব পক্ষই দোহার সঙ্গে আলোচনা করত। ফলে ধীরে ধীরে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়নক হয়ে উঠেছিল দোহা। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভিয়েনা যে ভূমিকা রাখত, দোহা ছিল ঠিক তেমনই। আর এগুলোই আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।’

সংকট সমাধানে এখন কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কাতার ও এর ওপর অবরোধ আরোপ করা সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। সুতরাং ‘শ্যাম রাখি, না কূল রাখি’ অবস্থায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলাসন এরই মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে কাতারের সঙ্গে যেন অন্যান্য দেশগুলো আপসে আসে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি আছে কাতারে। তাই কাতারকে বাদ দিয়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ে কথা বলতে বেশি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। তারা চাইছে বিরোধ যেন ধামাচাপা পড়ে। কিন্তু এখনো সেই কাজে সাফল্য আসেনি।

আরব অঞ্চলে এখন চলছে যুক্তরাষ্ট্রকে কাছে টানার লড়াই। কাতার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। আবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বরাত দিয়ে সৌদি আরব দাবি করছে, মার্কিন সরকার তাদের পক্ষেই আছে। গত সোমবার ওয়াশিংটনে থাকা সৌদি দূতাবাস দাবি করেছে, ট্রাম্প ক্ষেপে আছেন কাতারের ওপর! সুতরাং উপসাগরীয় এই ঝগড়া যে শিগগিরই শেষ হচ্ছে না, সেটি একরকম নিশ্চিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ