পুতিনের রাশিয়া কার জন্য কতটা হুমকি

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি রাশিয়ার যেকোনো আগ্রাসী পদক্ষেপকে বাধা দিতে ও দুশ্চিন্তায় থাকা মিত্রদের আশ্বস্ত করতে সামরিক জোট ন্যাটো সম্প্রতি তার সেনা মোতায়েন কর্মসূচি পর্যালোচনা করে। এরই মধ্যে ন্যাটো চারটি ‘যুদ্ধ দল’ মোতায়েন করেছে।

চারটি যুদ্ধ দলের একটি মোতায়েন করা হয়েছে পোল্যান্ডে। বাকি তিনটি দল বাল্টিক প্রজাতন্ত্র লাটভিয়া, লিথুনিয়া ও এস্তোনিয়ায় মোতায়েন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত তাদের ইউনিটগুলো পুনরায় পশ্চিম ইউরোপে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। এত সব আয়োজনের সূত্রপাত হয়েছে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনে বিদ্রোহীদের প্রতি দেশটির সমর্থন অব্যাহত রাখার কারণে।

জর্জিয়ার মতো ইউক্রেনকে টুকরো টুকরো করার মাধ্যমে মস্কো যদি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করে, তবে অনেকে বিশ্লেষকরই আশঙ্কা—ভবিষ্যতে বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলোর পরিণতিও সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলগুলোর মতো হবে। ন্যাটোর সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া জানিয়েছে, তারা নিজেদের নতুন ঘাঁটি তৈরি করছে। তবে বাস্তবতা কিন্তু আরও বেশি জটিল।

রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় পর্যবেক্ষক এবং কনফ্লিক্ট স্টাডিজ রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক কে জায়াল্‌স বলেন, ‘রাশিয়ার বর্তমান সামরিকীকরণ ও সংঘাতের প্রস্তুতি আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে যে ন্যাটোরই একই ধরনের কাজের প্রত্যুত্তরে তারা এটি করছে। তবে সাধারণভাবে তা সত্য নয়। কারণ ইউক্রেন সংকটের আগে থেকেই রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক ব্যয়বহুল পুনর্গঠন কর্মসূচি পুরোদমে চলছে। আর ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো এখনো শক্তি কমিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউরোপ থেকে তার সব অস্ত্র প্রত্যাহার করে নেয়, তখন রাশিয়া তার বাহিনীর আধুনিকায়নে শত শত কোটি ডলার খরচ করেছে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দিমিত্রি গোরেনবার্গ বলেন, ২০০৯ সালে রাশিয়া তার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন শুরু করে। জর্জিয়ায় সেনা অভিযানের সময় বাহিনীর ত্রুটিগুলো ধরা পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন কর্মসূচি শুরু করে। কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নতি ও সেনাদের মধ্যে সিদ্ধান্তের বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া, সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন শাখার মধ্যে তথ্য বিনিময় এবং সোভিয়েত যুগের সরঞ্জামের স্থলে আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ। সোভিয়েত যুগের ওই সামরিক সরঞ্জামগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল।’

উইলসন সেন্টারের কেনান ইনস্টিটিউটের মাইকেল কফম্যানের মতে, রাশিয়ার এসব পদক্ষেপে উল্লেখযোগ্য ফল হয়েছে। ২০১২ সালের মধ্যে তারা সোভিয়েত যুগের সশস্ত্র বাহিনীকে পুনর্গঠন করে স্থায়ী বাহিনীতে পরিণত করে। ২০০৮ সালে রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধে যেখানে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী নিষ্প্রভ ছিল, সেই অবস্থান থেকে রাশিয়া উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। কফম্যান বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধেও রাশিয়া অপ্রত্যাশিত কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ের অভাব বোধ করে। দেশটি উপলব্ধি করে, তাদের সীমান্তে স্থায়ী বাহিনীর অভাব রয়েছে। রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া এখনো চলছে।

ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলেও কে জায়াল্‌স উল্লেখ করেছেন, রাশিয়া তার পশ্চিমের এলাকাগুলোতেও সামরিক অবকাঠামোর উন্নয়ন করছে। কেবল ইউক্রেন সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নয়; বেলারুশ, বাল্টিক দেশগুলো এবং এমনকি ফিনল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকাতেও রাশিয়া এ উন্নয়ন কর্মসূচি চালাচ্ছে। যুদ্ধের সময় দেশটি যাতে পশ্চিমা সীমান্তে যত দ্রুত সম্ভব সেনা পাঠাতে পারে, সে জন্য তারা এসব কর্মসূচি চালাচ্ছে। চিরাচরিত রেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তারা ভারী যান চলাচলের জন্য সড়ক যোগাযোগ উন্নত করছে, যাতে প্রয়োজনে ভারী সাঁজোয়া যান কার্যক্রম চলা এলাকাগুলোতে পাঠানো যায়।

ইউক্রেনের ওপর মস্কোর নজর পড়ায় রাশিয়াকে হুমকি বিবেচনা করে ন্যাটোভুক্ত কিছু দেশ কি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে? কে জায়াল্‌স বলেন, মোটেই তা নয়। বরং তার বিপরীতটাই লক্ষ করা গেছে। তিনি মনে করেন, এটাই উদ্বেগের বিষয় যে ন্যাটো বরং কম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীদের ওপর সামরিক বাহিনী ব্যবহারের ঘটনায় রাশিয়ার যে আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে, তাতে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

জায়াল্‌স আরও বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরুরি ভিত্তিতে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো তো দূরের কথা জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার মতো প্রতীকী প্রতিশ্রুতিও ন্যাটোভুক্ত অনেক দেশই পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মাইকেল কফম্যানের মতে, পুনর্গঠন, আধুনিকায়ন এবং ইউক্রেন ও সিরিয়া যুদ্ধ থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা স্থায়ী প্রভাব ফেলবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর ওপর। তিনি বলেন, সীমান্তের যেকোনো জায়গায় বাহিনী মোতায়েন এবং সাবেক সোভিয়েতভুক্ত যেকোনো দেশের ওপর খবরদারি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে রাশিয়া। কৌশলগত পরমাণু অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়া কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষই নয়, অকৌশলগত পরমাণু অস্ত্রের আধুনিকায়ন এবং বিনিয়োগেও তারা মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগিয়ে।

বড় ধরনের কোনো যুদ্ধে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা ন্যাটোর মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গেও লড়াই করার সক্ষমতা অর্জন করেছে রুশ বাহিনী। এ ধরনের কোনো সংঘাত হলে তা উভয় পক্ষের জন্য রক্তক্ষয়ী হবে।

দিমিত্রি গোরেনবার্গও মনে করেন, ‘রাশিয়ার সক্ষমতা ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কাছাকাছিই।

সর্বোপরি, ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার অবস্থান, প্রস্তুতি এবং দ্রুত বড় ধরনের হামলার চালানোর সক্ষমতা স্থানীয়ভাবে রাশিয়াকে তাৎক্ষণিক সুবিধা এনে দেবে। তবে এই হুমকি ন্যাটোর বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। মাইকেল কফম্যান উল্লেখ করেন, রাশিয়া একটি ইউরেশীয় ভৌগোলিক শক্তি। লড়াই করার মতো তাদের পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের কাছাকাছি অঞ্চলে লড়াইয়ে তাদের শক্তি আরও বেশি। আর ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ও গবেষণায় যে বরাদ্দ থাকে, তা রাশিয়ার চেয়ে কম।

কফম্যান বলেন, রাশিয়াকে নিয়ে ন্যাটোর মূল দুশ্চিন্তা স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের ক্ষেত্রে। বাস্তবতা হলো, ন্যাটো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক জোট। এই জোটের সম্ভাব্য সামরিক ক্ষমতা অবিশ্বাস্য রকমের শক্তিশালী। টেকসই কোনো লড়াই হলে শেষ পর্যন্ত তা মস্কোর ধ্বংস ডেকে আনবে। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে নতুন করে সেনা জোগান দেওয়া রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ন্যাটোর প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। তবে পশ্চিমের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাইবার অভিযান এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। ন্যাটোর জন্য বর্তমানে এটাই বড় হুমকি। এই লড়াইয়ে পশ্চিমাদের প্রস্তুতি ভালো নয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ