যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বেশি জরুরি

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন গৃহবধূ সোমা বেগম। তাঁর জিহ্বা ও বাঁ পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন স্বামী। সোমা বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর চাহিদামতো যৌতুক এনে দেননি। স্বামী বেলাল মিয়ার চোখে তো এটা বিরাট অপরাধ। আর এই ‘অপরাধের’ শাস্তি হিসেবে স্ত্রীর জিহ্বা আর পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন তিনি।

রোমহর্ষক এই ঘটনা ঘটেছে ১৫ ডিসেম্বর সিলেট সদর উপজেলার পশ্চিম দর্শা গ্রামে। ১৯ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন দৈনিকে খবরটি ছাপা হয়। শিউরে ওঠার মতো খবর। পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী, আট বছর আগে সোমা বেগমের বিয়ে হয় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লামুয়া গ্রামের বেলাল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের তিন বছর পর বেলাল গোপনে আরেকটি বিয়ে করেন। এ নিয়ে সোমা তেমন একটা উচ্চবাচ্য না করলেও বেলাল যৌতুকের দাবিতে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো শুরু করেন। কী আশ্চর্য! গোপনে আরেকটি বিয়ে করা নিয়ে কোনো লজ্জা বা অনুশোচনা তো নেই, উল্টো প্রথম স্ত্রীর ওপর নির্যাতন!

নির্যাতন সইতে না পেরে বছর খানেক আগে বাপের বাড়িতে চলে এলেও রেহাই মেলেনি সোমার। মাঝেমধ্যেই বেলাল এসে সোমার কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়েছেন। ১৫ ডিসেম্বরও কয়েকজন সহযোগী নিয়ে টাকা চাইতে আসেন বেলাল। এ সময় চাহিদামতো টাকা না পেয়ে রাগে উন্মত্ত হয়ে যান বেলাল। প্রথমে সহযোগীদের সহায়তায় বেলাল ওড়না দিয়ে সোমার মুখ বেঁধে চাকু দিয়ে জিহ্বার অগ্রভাগ এবং পরে বাঁ পায়ের রগ কেটে দেন। তার মানে প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন বেলাল। অর্থাৎ, তিনি জানেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটালেও তাঁর কিছুই হবে না। এ ঘটনায় মামলা হলেও যখন এ লেখা লিখছি, তখন পর্যন্ত বেলালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

গত জুলাই মাসে এ রকম যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে ভয়াবহ নির্যাতনের আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরের সঙ্গে ছিল নির্যাতনে আহত স্ত্রী রিফাহ তাসফিয়ার ছবি। চাহিদামাফিক যৌতুক না পাওয়ায় তাসফিয়ার স্বামী তাঁকে জিআই পাইপ দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন। নির্যাতনে তাসফিয়ার দুই হাত, পা, মাথা ও বুকের হাড় ভেঙে যায়। ওই খবর অনুযায়ী, এ নির্যাতনে স্বামীর পরিবারের লোকজনের সমর্থন ছিল।

এটা বিস্ময়কর যে বাংলাদেশের নারীদের আজকের এই যুগেও যৌতুকের জন্য এ ধরনের বর্বর কায়দায় নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে! এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারছে, তার কারণ হচ্ছে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। আরও সমস্যা হচ্ছে যৌতুকের প্রতি এক নীরব সমর্থন রয়েছে সমাজের। এটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। তাই এর বিরুদ্ধে কাউকে খুব একটা সোচ্চার হতে দেখা যায় না।

কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে ‘গাছের গুঁড়ির পেছনে লুকিয়ে আছে দুষ্ট প্রথা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে ভোলা জেলার একটি বাজারে ফার্নিচারের দোকানের আধিক্যের বর্ণনা করা হয়। এত ফার্নিচারের দোকান গড়ে ওঠার পেছনের কারণ হচ্ছে বিয়েশাদিতে যৌতুক হিসেবে ফার্নিচার দিতে হয়। প্রতিবেদনে ওই বাজারের একজন ব্যবসায়ীর বক্তব্য তুলে ধরা হয়। তিনি বলেছেন, মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করলে তো যৌতুক দিতে হবে। পাত্র সরকারি চাকরি করলে সঙ্গে মোটরসাইকেলও দিতে হবে। বর বাহরাইন বা সিঙ্গাপুরপ্রবাসী হলে এসবের পাশাপাশি লেপ-তোশক, হাণ্ডি-পাতিলও দিতে হবে। এটাই সমাজের রীতি।

ওই ব্যবসায়ীর বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয় যে যৌতুকের বিষয়টি আমাদের সমাজের কত গভীরে শিকড় গেড়ে আছে। কি দরিদ্র, কি ধনী, সব পরিবারেই মেয়ের বিয়েতে বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া অবশ্যপালনীয় রীতিতে পরিণত হয়েছে। আর এর অন্যথা হলে অনেক ক্ষেত্রেই নেমে আসে স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন।

এ জন্যই আমরা দেখে আসছি, ছেলেসন্তান হলে সাধারণত মা-বাবারা খুশি হন, আর মেয়েসন্তান হলে বেজার। তাঁরা জানেন, মেয়েসন্তান হলেই তো তাকে এই সামাজিক রীতির শিকার হতে হবে। তাদের অবস্থা হবে সোমা বেগম আর তাসফিয়ার মতো। এখন সোমা বেগম ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না, পারছেন না দাঁড়াতে। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সোমা আবার হাঁটাচলা করতে পারলেও জিহ্বা কেটে ফেলায় কথা বলতে পারবেন না কোনো দিন। সোমা আর তাসফিয়ার মতো আরও কত নারী যে এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির ‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হন ৩৯২ জন নারী। এর মধ্যে হত্যা করা হয় ১৯২ জনকে। আর আত্মহত্যা করেন ১৮ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪০ জন।

এ অবস্থা তো চলতে পারে না। আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে এই প্রথাকে বর্জনের বিষয়টির দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ছেলেদের মা-বাবাদের বলছি, ছেলের বিয়েতে যৌতুক নেবেন না। আর মেয়েদের মা-বাবাদের বলছি, মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেবেন না। সবাই এই দুষ্ট প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর রাষ্ট্রের কাছে আমাদের আবেদন, যাঁরা যৌতুকের জন্য নারীদের ওপর নির্যাতন করেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি দিন। বিচার ও আইনের কঠোর প্রয়োগই নারী নির্যাতনের অবসানে ভূমিকা পালন করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ