রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না: প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি, এবিসিনিউবিডি,

ঢাকা : রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের যে কোনো ক্ষতি হবে না সেই ‘প্রমাণ’ দিয়ে এই প্রকল্প সরানোর দাবি প্রত‌্যাখ‌্যান করেছেন প্রধানমন্ত্রী। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

২৭ আগস্ট (শনিবার) বিকাল ৪টায় গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা জানিয়েছেন ।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ও ভিডিচিত্র দেখানো হয়। এতে বলা হয়েছে, সুন্দরবন থেকে নিরাপদ (১৪ কিমি) দূরত্বে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ফলে এতে সুন্দরবন ও এর আশপাশের এলাকায় পরিবেশগত কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েবে না।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এতোদিন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম এর পেছনে শক্তিটা কোথায়? এতদিন পরে দেখলাম, খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে এই অপপ্রচারে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সবসময় উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করেছে। জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। সরকার জনগণের সেবক, এটা আওয়ামী লীগই কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বঙ্গবন্ধুকন‌্যা হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকদের তার উপর আস্থা রাখার আহ্বান জানানোর সঙ্গে বিরোধিতাকারীদের সতর্কও করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “একটি নন-ইস্যুকে ইস্যু করে কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে চায়, তাহলে তা কঠোর হাতে দমন করতে আমরা পিছ পা হব না।”

তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বনের কাছে বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের নজির দেখানোর পাশাপাশি সুন্দরবনে যে কোনো দূষণ এড়াতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন। এরপর রামপাল বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের গুরুত্ব তুলে ধরে একটি প্রামাণ‌্যচিত্র দেখানো হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রী লিখিত বক্তব‌্যে বলেন, “দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু ভালো মনে হবে, আমি সেগুলো করবই।

“আপনারা আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আমি এমন কোনো কাজ আগেও করিনি, ভবিষ্যতেও করব না, যা দেশের এবং দেশের মানুষের সামান্যতম ক্ষতি করে।”

ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ‌্যোগে বাগেরহাটের রামপালে ১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ‌্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে, যা বিশ্ব ঐতিহ‌্য সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকিতে ঠেলে দেবে দাবি করে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে বাম দলগুলো।

এরপর খালেদা জিয়া গত ২৪ অগাস্ট সংবাদ সম্মেলনে রামপাল প্রকল্পটিকে ‘দেশবিরোধী’ আখ‌্যায়িত করে তাপবিদ‌্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের কাছ থেকে অন‌্য এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।

ওই সংবাদ সম্মেলনের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, “অবশেষে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। এতদিন অন্তরালে থেকে ইন্ধন জোগালেও ওই দিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রেস কনফারেন্স করে এই অপপ্রচারে প্রকাশ্যে সামিল হয়েছেন।

“আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে বিএনপির এই অপপ্রচারে প্রকাশ্যে যোগ দেওয়ার পেছনে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে যদি কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই থাকত, তাহলে তারা অনেক আগেই তা জনসম্মুখে প্রকাশ করত।”

হলি আর্টিজান এবং শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা নিয়ে ফায়দা আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে খালেদা জিয়া রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনকে উসকে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে বলে মন্তব‌্য করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

‘রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াদের’ অপপ্রচারে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এতদিন ধরে আন্দোলন চালানোর পেছনে বিএনপির ‘খোঁটার জোর’ ছিল বলেও মনে করেন শেখ হাসিনা।

বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ‌্যাসের সঙ্কট দেখা দেওয়ায় মূল্য এবং প্রাপ্যতার দিক থেকে কয়লা এখন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপান, ভারত তাদের মোট বিদ্যুতের ৪০ থেকে ৯৮ শতাংশ উৎপাদন করে কয়লা দিয়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে কয়লা বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশের সামান্য বেশি।

বাংলাদেশের অব্যাহত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ এবং যৌক্তিক মূল্যে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য রামপালে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণের কথা বলেন তিনি।

“রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে দেশের উন্নয়নবিরোধী একটি মহল বেশ কিছুদিন যাবত ভিত্তিহীন, কাল্পনিক ও মনগড়া বক্তব্য এবং তথ্য দিয়ে এ প্রকল্প সম্পর্কে মানুষের মনে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব এবং ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে।”

রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতাকারীরা মূল বক্তব্য হচ্ছে, এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গরান বন সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আপনাদের সামনে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে প্রমাণ করে দিব, বাস্তবায়নাধীন রামপাল-বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।”

আন্তর্জাতিকভাবে গভীর বনভূমির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার আইন থাকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের প্রান্ত সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।”

এই এলাকার বায়ুপ্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে- এই তথ‌্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “সামান্য পরিমাণ ক্ষতিকারক বায়বীয় পদার্থও যদি নিঃসরণ হয়, তবে তা সুন্দরবনের দিকে নয়, উল্টোদিকে প্রবাহিত হবে।”

খালেদা জিয়া তার পুরো বক্তব্যে ‘উদ্ভট, বানোয়াট এবং অসত্য’ উপাত্ত পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

খালেদা জিয়া তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করবে।

জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “এ কথা মোটেই সত্য নয়। বরং, এটি নির্মিত হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।”

সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষের চুরি করে গাছ কাটার প্রয়োজন আর হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “কোম্পানি থেকে বছরে ৩০ কোটি টাকা সিএসআর ফান্ডে জমা হবে। তা দিয়ে এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কাজ করা হবে। লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, শব্দ ও আলো দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। গভীর সমুদ্র হতে কভার্ড বার্জে কয়লা পরিবহন করা হবে। বার্জে ব্যবহৃত হবে ঢাকনাযুক্ত কম শব্দযুক্ত ইঞ্জিন। ফলে পরিবেশ দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শব্দ দুষণ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকবে। ১৪ কিলোমিটার দূরে শব্দ যাবে না। ২০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের কথাও বলেছিলেন খালেদা জিয়া, যার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “কিন্তু কত সংখ্যক কয়লাভিত্তিক প্ল‌্যান্ট চালু আছে, তা কি তার জানা আছে?

“যুক্তরাষ্ট্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে কয়লা থেকে। সেখানে ৭ হাজারের বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে।”

রামপালে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম আট দশমিক ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে জানিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে ‘সম্পূর্ণ অসত্য কথন’ আখ‌্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে কয়লার দামের উপর ভিত্তি করে।

সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম।

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনের নিকটবর্তী বাগেরহাটের রামপালে নির্মিত হচ্ছে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’।

প্রকল্পে সহায়তা করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের জন্য ৪৩০ একর ভূমি উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া চলছে প্রাথমিক অবকাঠামোর কাজ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ