ইট ওয়াজ বেটার টু শুট মি’

চট্টগ্রাম ডেস্ক, এবিসিনিউজবিডি,

ঢাকা: পেশাগত কারণেই ঝুঁকি তার নিত্যসঙ্গী। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ায় হুমকি আসত মাঝেমধ্যেই, নানা মাধ্যমে। সেগুলোকে খুব একটা পাত্তা দেননি এসপি বাবুল আক্তার। তবে নিজের জীবনের পরোয়া না করলেও শঙ্কায় ছিলেন পরিবার নিয়ে। ঘনিষ্ঠজনদের প্রায়ই সে কথা বলতেন। ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছেন।

নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে যে গলদ ছিল সেটা বোঝা গেল গতকাল রোববার সকালে, যখন দুর্বৃত্তরা ছুরি মেরে ও গুলি করে তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করে সবার সামনে দিয়ে নিরাপদে চলে গেছে।

এসপি হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বাবুল আক্তার। পদোন্নতির আগে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উত্তর-দক্ষিণ জোনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

কথা ছিল, একটু থিতু হয়েই স্ত্রী ও দুই সন্তানকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসবেন। কিন্তু তার আগেই দুর্বৃত্তের হামলায় তছনছ হয়ে গেল তার সাজানো সংসার।

গতকাল সকালে স্বজনদের কাছে স্ত্রী হত্যার খবর পেয়ে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম যান বাবুল আক্তার। সহকর্মীরা দ্রুত তাকে নিয়ে যান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তখন নিথর পড়ে ছিলেন মিতু। প্রিয় মুখটি এক নজর দেখেই শিউরে ওঠেন। মুখের কথা হারিয়ে ফেলেন।

চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরে অশ্রু। নগরীর জিইসি মোড়ে নিজের বাসায় ঢুকে সন্তানদের দেখে অস্থির হয়ে পড়েন তিনি (বাবুল)। কিছুতেই তাকে স্থির করা যাচ্ছিল না। পরিস্থিতি সামাল দিতে দুই সন্তানসহ বাবুল আক্তারকে তার বাসার পাশে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিনের বাসায় নেওয়া হয়। দুপুর ১টার দিকে সেখানে তাকে দেখতে যান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের স্ত্রী এবং পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তাদের সঙ্গে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাবুল আক্তার বুক চাপড়ে কাঁদছেন, কপাল চাপড়াচ্ছেন। সহকর্মীরা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কান্নার ফাঁকে ধরা গলায় বাবুল আক্তার বলেন, ‘কেউ নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি। আমি চেয়েছিলাম, তাদের ঢাকায় নিয়ে যাব, কিন্তু তার আগেই আমার সন্তানরা মাকে হারাল।’ চোখের পানিতে বুক ভিজে যাচ্ছিল তার। জ্বর এসেছে—গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠলেন এক সহকর্মী। দ্রুত ওষুধ এনে খাইয়ে দিলেন আরেক সহকর্মী।

ওষুধ খেয়ে খানিক নীরব থেকে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বাবুল আক্তার। সেই সঙ্গে বললেন, ‘ইট ওয়াজ বেটার টু শুট মি (এর চেয়ে আমাকে গুলি করলেই ভালো হতো)।’ আক্ষেপ করে বললেন, তাকে হত্যা করা হলে সমস্যা ছিল না। দুই বাচ্চাকে তাদের মা দেখাশোনা করে রাখতে পারত। বড় করতে পারত। এখন বাচ্চাদের মা নেই। দুই বাচ্চাকে কিভাবে বড় করব? কে দেখবে ওদের?

হুমকির কথা উঠতেই বাবুল আক্তার বললেন, ‘হুমকি আগে থেকেই ছিল। জেলখানা থেকে চিঠি গেছে, সেখানে আমার নাম ছিল। গাইবান্ধা থেকে সেই চিঠি উদ্ধার হয়েছে। জীবনের ওপর হুমকি ছিল।’ এর মধ্যেই পাশের কক্ষ থেকে ছুটে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বড় ছেলে আক্তার মাহমুদ মাহির (৬)। তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ফের কাঁদতে থাকেন বাবুল আক্তার। ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গলা ধরে আসে, কথা আটকে যায়।

ঘরে তখন পিনপতন নীরবতা। সবাই কাঁদছে। নীরবতা ভাঙেন বাবুল নিজেই, ‘আমি মিতুকে কিছুই দিতে পারিনি। এমনকি কখনো একটি ভালো কাপড়ও কিনে দিইনি। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি। …পারিনি। কিছুই পারিনি।’ জানালেন, তাঁর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে।

তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। তার ফাঁকে অস্ফুষ্ট স্বরে ধরা গলায় কথা বলছিলেন বাবুল আক্তার। তার মর্ম উদ্ধার করা গেল না। যিনি তা বুঝতে পারতেন তখন তার ময়নাতদন্ত চলছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে।

স্বজন ও সহকর্মীরা জানান, মাহমুদা খানম মিতুর বাবা ছিলেন পুলিশের পরিদর্শক। বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। বাবার ঘরে অত্যন্ত আদরে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু বিয়ের পর বাবুল আক্তারের সংসারে এসেই মিতু বুঝতে পারেন, মানুষের জীবন কতটা সাদামাটা হতে পারে।

তবে কোনো আক্ষেপ ছিল না মিতুর। দ্রুত সেই আটপৌরে জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেন। আপন করে নেন পরিবারের অন্যদের। অল্পতেই তুষ্ট থাকতেন তিনি। বাইরে কখনো তাকে অপ্রয়োজনীয় খরচ কিংবা বিলাসিতা করতে দেখেনি কেউ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ