বাংলাদেশ নিয়ে একাত্তরের পর ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের’ মুখে ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসিনিউজবিডি, (১৯ ডিসেম্বর) : বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের জন্য ‘সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ’ বলে মনে করছে ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটি।

ভারতের কংগ্রেস দলীয় এমপি শশী থারুরের নেতৃত্বাধীন ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের চ্যালেঞ্জ ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন, একটি মানবিক সংকট এবং একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু বর্তমান চ্যালেঞ্জটি আরও গভীর। এটি একটি প্রজন্মগত বিচ্ছিন্নতা, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং ভারতের দিক থেকে সম্ভাব্য কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত বহন করে।

‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশে বর্তমান অস্থিরতার পেছনে ‘ইসলামি চরমপন্থার উত্থান’, ‘চীন ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা’ এবং ‘শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের আধিপত্যের পতন’ দায়ী। তাই এই মুহূর্তে ভারত নিজের কৌশল পুনর্গঠন করতে ব্যর্থ হলে ঢাকার কাছে নিজের কৌশলগত অবস্থান হারাবে। আর তা তারা যুদ্ধের মাধ্যমে হারাবে না, হারাবে গুরুত্বহীন কিছুতে পরিণত হয়ে।’ কমিটি সে দেশের সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাবিষয়ক ইস্যুগুলোর ওপর সতর্ক নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছে।

কমিটি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে অবকাঠামো, বন্দর উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। এ প্রসঙ্গে মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি এবং পেকুয়ায় অবস্থিত সাবমেরিন ঘাঁটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে বর্তমানে চীনের তৈরি দুটি সাবমেরিন থাকলেও পেকুয়া ঘাঁটিতে সর্বোচ্চ আটটি সাবমেরিন রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে কমিটি বলেছে, ‘বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীসহ সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে চীন। এমনকি ইসলামপন্থি এই দলটি চীন সফরও করেছে।’

কমিটি সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি শক্তি যাতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে না পারে, সে বিষয়ে ভারত সরকারকে কঠোর নজরদারি চালাতে হবে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে টালমাটাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে উন্নয়ন, সংযোগ ও বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে তুলনামূলক সুবিধা দেওয়ার বার্তাও দিয়েছে তারা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্থল সীমান্ত চুক্তি ও সামুদ্রিক সীমা নির্ধারণ চুক্তির মতো অতীতের সমঝোতার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তবে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কমিটি। ওই সময় ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কমিটি বলেছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ও পরে ভারতের ‘নীরব কূটনীতি’র প্রশংসা করে কমিটি বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের অংশীজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে ভারতবিরোধী তথ্য ছড়ানোর বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিটি ভারত সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরতে বলেছে। পাশাপাশি ভ্রান্ত তথ্য নজরদারি এবং ভারতের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের সুপারিশও করেছে।

শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান প্রসঙ্গে কমিটি বলেছে, ভারত মানবিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ অনুরোধসংক্রান্ত যেকোনো অগ্রগতির বিষয়ে সংসদকে অবহিত রাখতে সরকারকে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রভাব ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার ওপরও পড়ে। তাই দুই দেশের মধ্যে আরও শক্তিশালী সমন্বয় ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের পাশাপাশি যেখানে সম্ভব সেখানে দ্রুত সীমান্ত বেড়া নির্মাণ এবং দুর্গম এলাকায় নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া ২০২৬ সালে বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ মর্যাদা থেকে উত্তরণের আগে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানিয়েছে কমিটি। পাশাপাশি বিলম্বিত সংযোগ প্রকল্পগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হওয়া গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন নিয়ে দ্রুত আলোচনা শুরু করারও আহ্বান জানানো হয়েছে এবং তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতেও অগ্রগতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে আসন্ন নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারছে না। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনগুলো কতটা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে বলেও মন্তব্য করেছে শশী থারুরের নেতৃত্বাধীন কমিটি। সূত্র: এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য উইক

মনোয়ারুল হক/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ