নদীভাঙনে গত এক দশকে বাস্তুচ্যুত কয়েক লাখ মানুষ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ, ঢাকা (৬ অক্টোবর) : ব্রহ্মপুত্র নদের কুলঘেঁষে গড়া ওঠা গ্রাম রতনপুর। কিছুদিন আগেও গ্রামটি ছিল ফসলভরা মাঠ। প্রাণচাঞ্চল্য ছিল নদীপাড়ের গ্রামটিতে। তবে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে যেন সেই দৃশ্য হারাতে বসেছে। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে এখন আতঙ্ক আর হাহাকার। নদীভাঙনে গ্রামটির প্রায় ৫০ বিঘা জমি বিলীন হয়ে গেছে। অনেকে হারিয়েছে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। এরই মধ্যে অন্তত ২০টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গৃহহারা পরিবারগুলো স্বজনদের বাড়ি কিংবা উঁচু স্থানে গিয়ে অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছেন। এভাবেই তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
কেবল গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামেরই নয়, সারা দেশের নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নিয়মিত দৃশ্য এটি।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, নদীভাঙনে তারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হন সেই তুলনায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সহযোগিতা পান সামান্যই। সরকারিভাবে তাদের দুঃখ লাঘবে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেয়া হয় না। এমনকি নদীভাঙনে প্রতি বছর কতজন বাস্তুচ্যুত হন, সরকারিভাবে সঠিক তথ্যও মেলে না।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আসিফ হাসান বিজয়। ২৮ বছর বয়সী এ তরুণের জীবনে এখন পর্যন্ত পাঁচ-ছয় বছর নদীভাঙনে বাড়িঘর হারাতে দেখেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। পরের বছর জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হয়। এর কিছুদিন পরই ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে আমাদের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যায়। পরে অন্য একটি চরে বসতি স্থাপন করে আমার পরিবার। কিন্তু সেখানে বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশনসহ নানা সমস্যা ছিল। একদিকে আমার পড়ালেখা, অন্যদিকে পরিবারের দুর্দশা। এভাবেই সেই সময়টি কেটেছিল।’
উত্তরের আরেক জেলা কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারের ভাঙনে প্রতি বছর দুই-আড়াই হাজার পরিবার তাদের বসতভিটা হারায় বলে স্থানীয় প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সে হিসাবে গত ১০ বছরে জেলার নয় উপজেলার নদ-নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটামাটি হারিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। বসতভিটা হারানো এ পরিবারগুলোর ৭০ ভাগই নদ-নদীর বুকে জেগে ওঠা নতুন চরে নতুন করে বসত গড়ে। আর ৩০ ভাগ পরিবার উঁচু এলাকা বা জেলার বাইরে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় সপরিবারে কাজের সন্ধানে চলে যান।
জেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, এ ইউনিয়নের এদিকে ব্রহ্মপুত্র, অন্যদিকে ধরলা। নদ-নদীর অববাহিকার ৮০ ভাগ এলাকা এখনো অরক্ষিত। সেসব এলাকায় সারা বছর নদী ভাঙন রয়েছে। তিন বছর আগে বেগমগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে থাকা ‘মুসার চর’ বিলীন হয়ে গেছে। সেই সময় ওই চরের শতাধিক বাসিন্দা পার্শ্ববর্তী বালাডোবার চরসহ বিভিন্ন জায়গায় বসতি স্থাপন করে।
বাংলাদেশে নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ। প্রতি বছর নদীভাঙন ও বন্যার কারণে বাংলাদেশের লাখো মানুষ অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হন। যদিও সঠিক কতজন মানুষ প্রতি বছর নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত হন তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। বন্যায় বাস্তুচ্যুতরা পানি নেমে গেলে পুনরায় বসতিতে ফিরতে পারলেও নদীতে ঘরবাড়ি বিলীন হওয়া মানুষের অধিকাংশই আর আগের জায়গা বসতি গড়তে পারে না।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) তথ্যমতে, গত বছর (২০২৪ সালে) দেশের ২৪ লাখ ২ হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হন। কারণ হিসেবে সংস্থাটি গত বছরের ভয়াবহ বন্যা, সংঘাতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলেছে। তবে নদীভাঙনের ফলে কতজন বাস্তুচ্যুত হয়েছে সেই তথ্য নেই সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে। সংস্থাটির ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংঘাতের কারণে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয় অন্তত ৪ কোটি ৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ২৩০ জনই ছিল বাংলাদেশের। তাদের প্রায় সবাই নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে উদ্বাস্তু হন। বাস্তুচ্যুতদের অনেকেই ঠাঁই নেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরের বস্তিতে। ওই বছরের সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীভাঙনের কারণে কোনো কোনো পরিবার ২৭ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙন তীব্র হচ্ছে। অকালবৃষ্টি ও বন্যা, নদীর দিক পরিবর্তন এবং সুরক্ষা বাঁধ না থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। বাস্তুহারা মানুষের কোথায় ঠাঁই হবে কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বন্যা, ঝড়, নদীভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ১ কোটি ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্থানান্তরিত হবে। এর মধ্যে ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ নদীভাঙনের কারণে স্থানান্তরিত হবে বলে সংস্থাটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, দেশের সবচেয়ে বেশি নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হন পদ্মা ও যমুনাপাড়ের বাসিন্দারা। ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনে পড়েছে ১ হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার—এমন তথ্য উঠে আসে সেই সময়ের এক প্রতিবেদনে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছিল, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের (প্রায় ২৫৬ বর্গমাইল বা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার) বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। ওই প্রতিবেদনে পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিংগার নেচার ১০৫ বছরে পদ্মার ভাঙন নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়েছে এর দুই পারের ১ হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। আর পলি পড়ে গড়ে উঠেছে ১ হাজার ৩১৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ওই সময়ে পদ্মাপারের মানুষ ৪৩৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি হারিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদ হোসেন বলেন, যারা ভাঙনের শিকার হন তাদের অনেকেই কৃষি ছেড়ে এক পর্যায়ে শহরে যেতে বাধ্য হন। তারা এরপর নানা শ্রমে যুক্ত হন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তাদের অধিকাংশই দরিদ্র ও কৃষক। সব হারিয়ে যখন নিঃস্ব হয়ে যান তখন উপায় না পেয়ে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হন। নদীভাঙন শুধু বাস্তুচ্যুতি ঘটাচ্ছে—সেটি না। এটি আমাদের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। এখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। তাদের আরো কাজ করতে হবে। এটি সত্য, ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে তারা ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এটি করলে ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।’