সরকারকে চাপে রেখেই নির্বাচনের প্রস্তুতি
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১৫ নভেম্বর) : জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি। ফলে সরকারের ওপর এখনো কিছুটা চাপ থেকে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার জুলাই সনদ আদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এরপর পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ওই দিন স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। জামায়াত সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করলেও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের এই গেজেটে তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে।
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবে ক্ষুণ্ন হোক, এটা চাই না। কোনো আরোপিত আইন দিয়ে, আদেশ দিয়ে, জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করতে দেব না। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন আট দলের পক্ষ থেকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টার অপসারণ চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে আট দলের নেতারা আপত্তি তুলে ধরেছেন।’
এদিকে এনসিপি গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম- সরকার অস্পষ্টতা দূর করে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা উল্লেখ করবে। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়নে এমন অস্পষ্টতা রয়ে গেছে যে এটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এটিকে ক্ষমতাবানরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে।’
বিএনপির পক্ষ থেকে গণভোটের দিনক্ষণের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও বিদ্যমান সংবিধানের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন দলটির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি গতকাল আবারও জাতীয় সংসদের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী অসন্তোষ প্রকাশ করলেও সরাসরি আন্দোলন বা নতুন কোনো কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেনি। তবে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সারা দেশে বিক্ষোভ করেছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। অসন্তোষ প্রকাশ সত্ত্বেও এনসিপি এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি দেয়নি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, দল তিনটিই (বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি) আপাতত অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। তবে তারা সরকারকে চাপে রাখার কৌশল থেকে এখনো পুরোপুরি সরে আসেনি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আর উত্তাপ না বাড়িয়ে এখন জাতীয় নির্বাচনমুখী হতে চায়। রাজপথের আন্দোলন নয়, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মাঠে থাকাই এখন প্রধান লক্ষ্যে দলগুলোর। ফেব্রুয়ারি মাসে যথাসময়ে নির্বাচন আদায় করার এখন বিএনপি, জামায়াতসহ সব দলের নজর। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবিতে অনড় থাকা জামায়াতসহ সমমনা আট দলও দু-এক দিনের মধ্যে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠান এবং শিগগিরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করায় প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপি সাধুবাদ জানিয়েছে বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গতকাল তিনি বলেছেন, ‘স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ প্রতিপালনে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, অঙ্গীকারবদ্ধ। জুলাই জাতীয় সনদ যেভাবে রচিত হয়েছে, প্রণীত হয়েছে, স্বাক্ষরিত হয়েছে- সেই জাতীয় সনদ আমরা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। এর বাইরে চাপিয়ে দেওয়া, জবরদস্তিমূলক কোনো প্রস্তাব যদি দেওয়া হয়, সেটা জনগণ বিবেচনা করবে।’
জানা গেছে, জুলাই সনদ আদেশ জারির পর জামায়াতের ইসলামীসহ সমমনা আটটি দল বৈঠক করে গত বৃহস্পতিবার। সেখানে জুলাই সনদের আদেশ জারির বিভিন্ন পয়েন্ট তারা পর্যালোচনা করেন। কোথায় ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে তা দেখেছেন। আগামীকাল রবিবার আবারও বৈঠকে বসবেন আট দলের শীর্ষ নেতারা। ওই বৈঠকে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীরসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকের পর জাতির বৃহত্তর স্বার্থ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য অটুট রাখতে জুলাই সনদকে স্বাগত জানিয়ে পরবর্তী ঘোষণা আসতে পারে।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ মেনে নিয়েছে। কারণ সংসদে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি (সংখ্যানুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব), সাংবিধানিক আদেশ, সংবিধান সংশোধনের উচ্চকক্ষের মতামত, গণপরিষদ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতি- জামায়াতের দাবি ছিল। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াতের গণভোটের দাবি পূরণ হয়নি। জুলাই সনদে গণদাবি উপেক্ষা করা হয়েছে বলে ওপরে ওপরে হাঁকডাক দিয়ে রাজনীতির মাঠ চাঙা রাখার কৌশলের পথে হাঁটতে চাইছে জামায়াত।
জুলাই সনদের সাংবিধানিক আদেশ জারির পর সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের জুলাই সনদের আদেশ জারি দাবি ছিল, এটি অর্জিত হয়েছে। তবে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি আমরা আবারও পুনর্ব্যক্ত করেছি, তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছি। কারণ জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলেও এর আসল টার্গেট পূর্ণ হবে না।’ তিনি জানান, আগামীকাল রবিবার বৈঠকে পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসবে।
জুলাই সনদের আংশিক দাবি প্রতিফলিত হয়েছে বলে জানিয়ে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই সনদে আমাদের আংশিক দাবি পূরণ হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ব্যাপারে আমাদের আপত্তি রয়েছে। একটি দলকে খুশি করতেই একই দিনেই গণভোট দিয়ে সরকার জুলাই সনদকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তবে কর্মসূচির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
জুলাই সনদ জারির আদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই জাতীয় সনদে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির কিছু কিছু দাবি পূরণ করা হয়েছে। তিন দলকেই সরকার খুশি রাখার চেষ্টা করেছে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করা। গণভোটে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আংশিক দাবি পূরণ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বিএনপি একমত থাকলেও গঠনপ্রণালি বিএনপির ভিন্ন আমলে নেয়নি সরকার। তবে জামায়াত নির্বাচনের আগেই গণভোট দাবি করেছিল। আর গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না এনসিপির।
অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপির দাবি অনুযায়ী জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন সাংবিধানিক আদেশ জারি, পিআর পদ্ধতিতে সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনপ্রণালি, সংবিধান সংস্কারে গণপরিষদ গঠন বা আগামী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা দেওয়ার দাবি পূরণ হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিএনপির ভিন্নমত আমলে নেয়নি সরকার। গণভোটে ‘নোট অব ডিসেন্টে’র আলাদা করে প্রশ্ন রাখায় ভিন্নমত রয়েছে দল দুটির। রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জুলাই সনদের আদেশ জারির বিপক্ষে ছিল এনসিপি। তাদের দাবি ছিল প্রধান উপদেষ্টা জারি করবেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি করতে পারেন, সেটিই হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের মতামতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিএনপির ভিন্নমত আমলে নেয়নি সরকার।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চেয়েছিলাম। এই আদেশের মধ্যে জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্ব অনুযায়ী আংশিক বাস্তবায়ন এবং আংশিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু সংস্কারকে কম গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে। সেগুলো দলগুলোর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
আর জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে অনেক কিছু অস্পষ্ট থাকলেও বাস্তবায়নের আদেশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এনসিপি বলে জানিয়েছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি মনে করি, জুলাই সনদ নিয়ে সামনের দিনে সংকট আর বাড়বে না। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সনদ যেভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, হয়তো সব দলই মেনে নেবে।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, জুলাই সনদের আদেশের কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব দলকেই মেনে নেওয়া উচিত। মতপার্থক্য থাকলেও সব দলের মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। তিনি বলেন, ‘একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে আসন নির্ধারণ এবং গণভোটে একমত ও ভিন্নমতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যালট তৈরি- কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আমি মনে করি, এটি এখন অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান।’
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাই সনদ ঘিরে সৃষ্ট সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু এখন জামায়াত নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানোর চেষ্টা করছে। তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে। পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে। জামায়াত ষড়যন্ত্র করে অতীতেও পানি পায়নি, এবারও পাবে না।’
