পট পরিবর্তনের পর অস্থির রাবি, অভিযোগের তির রাকসুর জিএসের দিকে
নিজস্ব প্রতিবেদক (রাজশাহী), এবিসিনিউজবিডি, (২৩ ডিসেম্বর) : চব্বিশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক চর্চাতেও বড় ধরনের রদবদল দেখা যাচ্ছে। তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি)। পোষ্য কোটা ইস্যুতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ, আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও ডিনদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে উসকানি ও হুমকিসহ ধারাবাহিক ঘটনায় গত কয়েক মাস ধরে অস্থিরতার কেন্দ্রে রয়েছে এই বিদ্যাপীঠ। এসব ঘটনার অধিকাংশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দিন আম্মারের নাম উঠে এসেছে।
পোষ্য কোটা ইস্যুতে সংঘর্ষ
চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ১০টি শর্তে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এর ধারাবাহিকতায় ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন প্রশাসন ভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলে শিক্ষার্থীরা তার গাড়ি আটকে দেন। প্রায় ২০ মিনিট তাকে গাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে তার বাসভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।
এতে উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জুবেরী ভবনের সামনে গেলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দীনের গলা চেপে ধরে সিঁড়িতে ফেলে দেওয়া এবং উপ-রেজিস্ট্রার রবিউল ইসলামের দাড়ি ধরে টান দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ভিডিওতে এসব চিত্র ধরা পড়ে। এসব ঘটনায় সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান রাকসু জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে।
ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম কর্মবিরতির ডাক দেয়। অফিসার্স সমিতি ক্যাম্পাস শাটডাউন ঘোষণা করলে কয়েক দিন কার্যত অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।
বারবার পেছায় রাকসু নির্বাচন
নানা কারণে রাকসু নির্বাচন চারবার পেছানো হয়। নির্বাচন পেছানো নিয়ে ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন প্যানেলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। শেষ পর্যন্ত ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে শাখা ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল ২০টিতে বিজয়ী হয়।
ডিনদের পদত্যাগের আলটিমেটাম ও তালা
রাবিতে আওয়ামীপন্থি ডিনদের পদত্যাগ এবং ফ্যাসিজমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অপসারণের দাবিতে ‘অপারেশন জিরো টলারেন্স ফর ফ্যাসিজম’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার। মেয়াদ শেষ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থি ডিনদের পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেন তিনি।
গত ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ও ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ’ নামের গ্রুপে পোস্ট দিয়ে তিনি এ আলটিমেটাম দেন। পরে গত ২১ ডিসেম্বর ছয় ডিনের কেউ ক্যাম্পাসে না থাকায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে একে একে তাদের ফোন করেন আম্মার। একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশে লেখা পদত্যাগপত্রও প্রকাশ করেন। এরপর তাদের পদত্যাগের দাবিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দেন একদল শিক্ষার্থী। প্রথমে ডিনস কমপ্লেক্সে এবং পরে প্রশাসন ভবনে তালা দেওয়া হয়। দিনভর উত্তেজনার পর সন্ধ্যায় ডিনদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় প্রশাসন।
নিরাপত্তা শঙ্কায় শিক্ষকের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন
নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন রাবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদ। গত ২১ ডিসেম্বর নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এর আগে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষে যারা নমনীয়তা উৎপাদন করবে, আমরা তাদের জুতা খুলে মুখে মারব ইন্শাআল্লাহ। রাবিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি চাকরি করে, তাদের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেঁধে রাখব।’
অরাজক পরিস্থিতির অভিযোগ ছাত্রদলের
আওয়ামীপন্থি ছয় ডিনের পদত্যাগের ঘটনাকে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার অপচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে শাখা ছাত্রদল। ২১ ডিসেম্বর রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ক্যাম্পাসে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্র করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারের হুমকিমূলক বক্তব্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি অশোভন ও অছাত্রসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ। একজন ছাত্রনেতার কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ জ্ঞানচর্চার পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।’
আম্মারকে ঘিরে বিতর্ক
ধারাবাহিক এসব ঘটনায় অভিযোগের তির ছুটছে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারের দিকে। যদিও তিনি দাবি করছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়েই তার সব ভূমিকা।
আম্মার বলেন, ‘আমি ক্যাম্পাসে যা করি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যই করি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী যেটা সমর্থন করে আমি সেটাই করি। আমি জানি শেষ পর্যন্ত হয়তো সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু আমি শিক্ষার্থীদের জন্য যা করে যাব, সেটাই থেকে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য যখনই কিছু করতে চাই, তখনই একটা পক্ষ বিরক্ত হয়। কখনো বিএনপিপন্থি, কখনো জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা। আমি দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরপেক্ষ কোনো শিক্ষক নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দলীয় স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো দলের সঙ্গে নেই। যত দিন ক্যাম্পাসে আছি শিক্ষার্থীদের জন্যই কাজ করে যাব।’
উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নোমান ইমতিয়াজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মূলত পড়াশোনার জায়গা। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে সেটা বলা মুশকিল। এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্র প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব ভুলে ভিন্ন কাজে বেশি আগ্রহী। একাডেমিক প্রশাসন ও রাকসু- সবই জাতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পড়ালেখার পরিবেশ বাস্তবেই বিঘ্নিত হয়েছে। মতাদর্শিক অবস্থান থাকবে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। কিন্তু সেটা দিয়ে যদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে আসে, তাহলে সেটা খুবই উদ্বেগজনক।’
ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রয়াসন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি আমি ভালো বলতে পারছি না এই মুহূর্তে।’
এদিকে গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক চত্বরে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে স্বাগত মিছিল পরবর্তী-সমাবেশ করেছে শাখা ছাত্রদল। সেখানে রাবি ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি শাকিলুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারকে মাত্র ৩০ মিনিটের ব্যবধানে ছাত্রদল ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিতে সক্ষম।’ এ বক্তব্যটি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আম্মার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘আলটিমেটাম দিলাম আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের পক্ষে থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা যদি ক্যাম্পাসে ঢুকে তাহলে জোহা চত্বরে বেঁধে রাখব। রেগে গেল ক্যাম্পাসের ছাত্রদল আর বিএনপি! ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ একই ভাষায় বিবৃতি দিল। বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা ভিসির কাছে নালিশ দিলেন, তারা নাকি ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছেন। বললাম লীগকে আর ভয় পাইতেছে বিএনপির টিচাররা।’
মনোয়ারুল হক/
