ইসলামী ব্যাংকের ‘বিশেষ দক্ষতা মূল্যায়ন’ পরীক্ষার আড়ালে কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের ষড়যন্ত্র!

চট্টগ্রাম ব্যুরো, এবিসি নিউজ, (২৭ সেপ্টেম্বর) : ইসলামী ব্যাংক পিএলসিতে ‘বিশেষ দক্ষতা মূল্যায়ন’ পরীক্ষার আড়ালে কর্মীদের ছাঁটাইয়ের ষড়যন্ত্র চলছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ওই পরীক্ষায় না বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার চাকরিজীবী। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকরিজীবীদের ছাঁটাইয়ের পাঁয়তারা করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ- এই অভিযোগ নিয়ে তারা হাইকোর্টেও গিয়েছিলেন।
এদিকে, চাকরি থেকে ছাঁটাই করার অপচেষ্টার ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ইসলামী ব্যাংকের ‘বিশেষ দক্ষতা মূল্যায়ন’ পরীক্ষা বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা। শুক্রবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে এই ঘোষণা দেন তারা। কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজারো কর্মকর্তা অংশ নেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা জানিয়ে দেন, পরীক্ষায় বসব তখন-ই, সবাই বসবে যখন-ই। এর অর্থ হলো সবাই যদি পরীক্ষায় অংশ নেন, তখন তারাও পরীক্ষা দিতে রাজি।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, আঞ্চলিকতার কারণে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে যারা ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করেন কেবল তাদের এই পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা তাই এ পরীক্ষাকে প্রহসনের পরীক্ষা বলছেন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলে আন্দোলনকারীরা তাকে এ বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা এস এম এমদাদ হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক একটি প্রহসনের পরীক্ষার আয়োজন করেছে। এর পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। পরীক্ষার নামে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সব কর্মীকে ছাঁটাই করতে চায় ব্যাংকের নতুন পরিচালনা বোর্ড।’
ইসলামী ব্যাংকের অন্য আরেক কর্মকর্তা এসকান্দর সুজন বলেন, ‘এখানে একেকজন কর্মী ৭ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত চাকরি করছেন। তাদের যদি চাকরিচ্যুত করা হয়, তাহলে তাদের পরিবারের কী অবস্থা হবে? হাইকোর্টও বলেছেন কর্মীদের প্রমোশন দেওয়ার জন্য পরীক্ষা নেওয়া যাবে, চাকরিচ্যুত করার জন্য নয়। কিন্তু সেটাও অমান্য করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।’
গত ২২ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ‘স্পেশাল কম্পিটেন্সি অ্যাসেসমেন্ট’ নামে এই পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে। এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক বলে নোটিশ জারি করে। তারিখ অনুযায়ী আজ শনিবার এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এ পরীক্ষার আড়ালে ব্যাংকে কর্মরত চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হবে বলে অভিযোগ করছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তারা।পরীক্ষা বয়কটের ঘোষণা দিয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের ডাক দেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাংকের শাখাগুলোতে কর্মরত চট্টগ্রামের বাসিন্দারা শুক্রবার ভোরে নগরীতে এসে পৌঁছান। সকাল ১০টা থেকে তারা জামালখান এলাকায় জড়ো হন। এরপর তারা বেলা ১১টার দিকে প্রেসক্লাব থেকে লিচুবাগান পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা বন্ধের দাবিতে নানা স্লোগান দেন। এ সময় তাদের হাতে ছিল- ‘পরীক্ষা দেব তখনই, সবাই বসবে যখনই’, ‘কর্মস্থলে সুখ মানে শুধু বেতন না, বরং সম্মান, ভারসাম্য ও স্বীকৃতি’, ‘একবার দিলাম পরীক্ষা, দুইবার দিতে রাজি না’, ‘সিএইচআরও জানেন নাকি, স্বৈরাচারের দোসর আপনি’, ‘হাইকোর্ট অবমাননা কেন, জবাব চাই, দিতে হবে’ সংবলিত ব্যানার ও ফেস্টুন।
এ সমাবেশে বক্তব্য দেন ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইস্কান্দার সুজন, এস এম এমদাদ হোসাইন, মোহাম্মদ ইকবাল, দিলরুবা আক্তার, শারমিন আক্তার, নাসরিন জান্নাত প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, ‘বিশেষ দক্ষতা মূল্যায়ন পরীক্ষার অজুহাতে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে। এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য বিশাল বড় ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র আমরা আগেই জানতে পেরেছি, তাই আজ রাস্তায় দাঁড়িয়েছি।’
এক মাস আগে এই পরীক্ষার অবৈধ প্রয়াসের বিরুদ্ধে আমরা রিট করলে, মহামান্য হাইকোর্ট পরীক্ষা প্রক্রিয়া স্থগিত করে নিয়মিত প্রমোশনাল পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককেও নির্দেশ দেন আদালত।
কিন্তু হাইকোর্টের সেই আদেশ উপেক্ষা করে ২২ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্পেশাল কম্পিটেন্সি অ্যাসেসমেন্ট পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণকে বাধ্যতামূলক করে নোটিশ জারি করেছে। নতুন তারিখ অনুযায়ী ২৭ সেপ্টেম্বর (আজ) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নোটিশে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ চাকরিতে বহাল থাকা এবং ক্যারিয়ারে উন্নতির পূর্বশর্ত। অনুপস্থিতদের আর কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।
এ পরিস্থিতি আমাদের মধ্যে যুক্তিসংগত ভয় ও আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য বৈষম্যমূলক এবং আমাদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। এটি স্পষ্টভাবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৯ ও ৩১ অনুযায়ী সমতা, সম-অধিকার এবং সমান কর্মসংস্থানের নীতির লঙ্ঘন।
পরীক্ষা বয়কটের ঘোষণা দিয়ে বক্তারা আরও বলেন, ‘আমরা সরকারি সব নিয়ম মেনে ব্যাংকে যোগদান করেছি। যোগদানের পর ব্যাংকের পদোন্নতিসহ নানা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। এখন তাই ছাঁটাই করার এই প্রহসন ও বৈষম্যমূলক পরীক্ষা আমরা দেব না। সারা বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা এই পরীক্ষায় অংশ নেবেন না।’
সভা থেকে সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। বক্তারা বলেন, ‘আমাদের দাবির বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আমরাও কঠিন আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধ্য হব। চট্টগ্রাম দেশের ব্যবসার চালিকাশক্তি। সারা বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি অচল করে দিতে আমাদের ২ মিনিটও সময় লাগবে না।’
নতুন বাংলাদেশে কোনো প্রহসন-বৈষম্য চলবে না উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, ‘আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বীর চট্টলার কৃতী সন্তান। চট্টগ্রামের সন্তানদের আকুতি আপনাকে শুনতে হবে। আপনি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা আশাবাদী।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ইসলামী ব্যাংকের কয়েক হাজার কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে, ‘বিশেষ দক্ষতা মূল্যায়ন’ পরীক্ষার অজুহাতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তাকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আদালতের স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও আবারও পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করায় কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ