ইলিশসংকটে ঐতিহ্য হারাচ্ছে চাঁদপুর

নিজস্ব প্রতিবেদক (চাঁদপুর), এবিসি নিউজ, (২৫ সেপ্টেম্বর) : চাঁদপুরের বড় স্টেশন মাছঘাট একসময় ছিল দেশের বৃহৎ পাইকারি ইলিশের বাজার। এখন ওই বাজার ইলিশসংকটে ঐতিহ্য হারাচ্ছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ বাজার খ্যাতি পেয়েছিল। প্রতিদিন এখানে অর্ধশতাধিক আড়তে হাজার হাজার মণ ইলিশ ওঠত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা এখানে ভিড় জমাতেন। এখানকার ইলিশের স্বাদ ও গুণমানের কারণে আলাদা কদর ছিল। ঢাকা ছাড়াও দেশের নানা প্রান্তে এখান থেকে ইলিশ সরবরাহ হতো। কিন্তু এখন সেই দৃশ্য ইতিহাস হয়ে গেছে। অর্ধশতাধিক আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি আড়তেই সীমিত পরিমাণ ইলিশ উঠছে। অন্যদিকে খুচরা দোকানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতাধিক। এতে পাইকারি বাজার ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে খুচরা বাজারে।

সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং চড়া দামের কারণে ইলিশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। গত বছর এক কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। বড় স্টেশনে প্রতিদিন ভিড় থাকলেও ক্রেতাদের অনেকেই খালি হাতে ফিরছেন।

ঢাকা থেকে মাছ কিনতে আসা সুজন হোসেন বলেন, ‘মাছ তাজা হলেও দাম অনেক বেশি। ১ কেজি ইলিশ ২ হাজার ৩০০ টাকা। সাধারণ মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তবুও কিছু কিনলাম, কারণ পরিবারে সবাই ইলিশ খেতে চায়।’ ক্রেতা ইসমাইল হোসেন যোগ করেন, ‘আর কিছুদিন পর মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। তবুও দাম কমছে না। তাহলে সাধারণ মানুষ কবে ইলিশ কিনবে? গত বছর এই সময় দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, এখন তা প্রায় দ্বিগুণ।’

বাজারে সরবরাহের অভাব ও চড়া দামের কারণে পাইকারি ব্যবসা সংকটে পড়েছে। অনেক আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা লোকসান সহ্য করতে না পেরে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ বহু বছরের আড়ত গুটিয়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। সংকটের সুযোগে খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এতে বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বিলীন হচ্ছে।

জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার বলেন, ‘প্রতিবছর ইলিশের সরবরাহ কমছে। ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়ছেন। কতদিন তারা লোকসান দিয়ে আড়ত চালাবে? কয়েক বছর আগেও এখানে হাতেগোনা খুচরা দোকান ছিল। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতাধিক। এভাবে চলতে থাকলে ঐতিহ্যবাহী বড় স্টেশন বাজার বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

বড় স্টেশন মাছঘাট কেবল অর্থনীতিতে নয়, বাঙালির সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাজার দেশের ইলিশ বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। একসময় এখান থেকে দেশের সব প্রান্তে ইলিশ পৌঁছাত। এখন ঐতিহ্য রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করা, জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা করা এবং ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এসব উদ্যোগ নিলে হয়তো আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী বড় স্টেশন মাছঘাট। না হলে একসময়কার গৌরবময় বাজার কেবল স্মৃতির পাতায় সীমিত হয়ে যাবে।

বড় স্টেশন মাছঘাট শুধুমাত্র একটি পাইকারি বাজার ছিল না। একসময় এটি দেশের ইলিশ বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। আজ ওই ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার পথে। ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের রূপান্তরও উদ্বেগজনক।

স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইলিশের সরবরাহ কমছে। দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাইকারি বেচাকেনা কমে গেছে। নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের আগ্রহও কমে যাচ্ছে। এখন খুচরা বিক্রেতা বাজার দখল করছে। এই প্রবণতা চলতে থাকলে একসময় বড় স্টেশন মাছঘাট কেবল গল্প হয়ে থাকবে।’

বিশেষজ্ঞরা জানান, মাছঘাটের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা, সুষ্ঠু সরবরাহ ব্যবস্থা ও ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে তৎপর হলে আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে। এ বাজার রক্ষা করা শুধু ব্যবসার জন্য নয়, দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণেরও বিষয়।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ