জাতীয় স্বার্থে দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার আহ্ববান জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কমিশনের
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ, ঢাকা (১৭ সেপ্টেম্বর) : জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে দ্বিমত নেই কোনো রাজনৈতিক দলের। তবে কোন পদ্ধতিতে সেটি করা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে দেড় মাস ধরে আলোচনার পরও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যরা।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিকে যেকোনো মূল্যে প্রশ্নাতীত রাখার পক্ষে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়া অথবা আইনি অন্য যেকোনো প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাবে দলটি। একাধিক সূত্র জানায়, আগামী সংসদ নির্বাচন নির্বিঘ্নে করার স্বার্থে জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্টে থাকা কয়েকটি ইস্যুতে কিছুট ছাড় দেওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। তবে জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়াকে কিছুতেই মেনে নেবে না তারা। অন্যদিকে এনডিএম ছাড়া সব দলই উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। তবে নিম্ন কক্ষে পিআর পদ্ধতি কখনো মেনে নেবে না বিএনপি। অন্যদিকে শুধু উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে রাজি এনসিপি। তবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন উভয় কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে এখনো অনড়। তার পরও এই পর্যায়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে ওই সব ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি ঐকমত্যে পৌঁছাতে আগ্রহী বেশির ভাগ দল।
চলমান পরিস্থিতিতে জাতীয় স্বার্থে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর কাছে আইনসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য সিদ্ধান্ত আশা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া ৪ ধরনের বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলো হলো- গণভোট, অধ্যাদেশ জারি, নির্বাহী আদেশ জারি এবং পরবর্তী সংসদের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ। এসব বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি জানতে চাইলে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ খবরের কাগজকে জানান, দলগুলোর ওপর কমিশন কিছুই চাপিয়ে দেবে না। এ বিষয়ে আলোচ্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে বাস্তবসম্মত বিকল্পের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে কমিশন। সেই লক্ষ্যে আগামীতে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে কমিশন।
ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত সংকট নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও আইনি ভিত্তি নিয়ে দলগুলো একমত হতে না পারলে শেষ মুহূর্তে সরকারের ওপর দায়ভার ছেড়ে দেবে বিএনপি। এই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে পরবর্তী কোনো প্রশ্ন বা আদালতে রিট করার সুযোগ তারা রাখতে চান না। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এর বাইরে অন্য কোনো আইনি পথ থাকলেও সেটিকে স্বাগত জানাবে বিএনপি। তবে জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়া যাবে না, এটা সংবিধানের ধারায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জাতীয় সংসদের নিম্ন কক্ষে পিআর পদ্ধতির বিষয়টি কখনো ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল না। আমরা উচ্চ ও নিম্ন কক্ষে সব জায়গায় পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। কিছু আসন পাওয়ার লোভে জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেউ পিআর পদ্ধতি চাইলে ভয়ঙ্কর পরিণতি নিয়ে আসবে। নির্বাচনকে বিলম্বিত অথবা বাধাগ্রস্ত করতে এ ধরনের রাজনৈতিক কৌশলকে এ দেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। ঐকমত্যে কমিশনের বৈঠকে যেসব বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করেছে সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। আর যেসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করতে হবে সেগুলো নিয়ে সংসদের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে চায় বিএনপি। তবে সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখনই বাস্তবায়নের কোনো বৈধ বা সাংবিধানিক উপায় যদি থাকে তাও মেনে নেবে বিএনপি।
দলটির অপর এক সূত্র জানায়, আগামী সংসদ নির্বাচন নির্বিঘ্নে করার স্বার্থে জুলাই সনদে কিছু বিষয়ে ছাড় দেওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। বিশেষ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’এর ৯টি প্রস্তাব নিয়ে এবারের আলোচনায় কয়েকটি বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে পারে। এর মধ্যে সংসদে উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতি (সংখ্যানুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব), রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতি নিয়ে ছাড় দিতে পারে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতি মেনে নিতে বিএনপির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
অপর দিকে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে অনড় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দল দুটির ভিন্ন মত। জামায়াতে ইসলামী বলছে, গণভোটের অথবা ‘প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার’ মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। আর এনসিপি বলছে, গণপরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এর ভিত্তিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার আগামী সংসদ ছাড়া বাস্তবায়নের কোনো আইনি পথ নেই। সাংবিধানিক আদেশ জারি বা গণভোটের মতো প্রস্তাবগুলো অগ্রহণযোগ্য। এখনই এই সনদ কার্যকর হলে দেশে দুটি সংবিধান চলমান থাকবে।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের জন্য ৩০টি রাজনৈতিক দলকে দুজন করে প্রতিনিধির নাম পাঠানোর অনুরোধ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু অনেক দল সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখে তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে ৩০টি দলের মধ্যে ১৭টি রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিনিধির নাম পাঠায়। আর নাম না পাঠানো দলগুলো যুক্তি দিয়ে বলেছে, ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে কপি পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে নোট অব ডিসেন্ট, আংশিক একমত, মতামত দেয়নি- এসব বিষয়ও তুলে ধরা হয়। এসব নোট অব ডিসেন্ট থাকা বিষয়গুলোকে তো ঐকমত্য বলা যায় না। তাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য নাম পাঠানো হয়নি। মূল ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য হলে ও আদর্শিক বিষয়গুলো ঠিক থাকলে সনদ স্বাক্ষরের জন্য নাম পাঠানো হবে।
এর আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় গত রবিবার দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিন আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত কমিশনের মেয়াদ বাড়াতে দলগুলো অনুরোধ জানায়। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার কার্যকাল শেষ হওয়া ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।