৭ মাসে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৬২টি অভিযোগ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ, ঢাকা (১৭ সেপ্টেম্বর) : প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী কেলেঙ্কারি, সরকারি সম্পদের অপচয়, রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি- সবই এখন নিয়মিত ঘটনা। আছে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার মতো অভিযোগ। ব্যক্তিগত তথ্য গোপন করে পদ-পদবি আদায় এবং বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগও রয়েছে; কিন্তু বিদ্যমান আইনের নমনীয়তা ও দুর্বল শাস্তি ব্যবস্থার কারণে অভিযুক্তরা প্রায়ই পার পেয়ে যাচ্ছেন। এতে মাঠ প্রশাসনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মাসে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১৬২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৫৬টি। সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক পোস্ট দেওয়া, সরকারি গাড়ি ও সম্পদ অপব্যবহার এবং প্রেষণে প্রকল্পভিত্তিক অনিয়মের অভিযোগও যুক্ত হচ্ছে নিয়মিত। ইউএনও, এসিল্যান্ড ও ডিসিদের বিরুদ্ধে সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগও বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
অতীতে বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা মাঠ প্রশাসনের ভাবমূর্তিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে শরীয়তপুরের ডিসি আশরাফ উদ্দিনকে সরে যেতে হয়। এর আগেও জামালপুর, দিনাজপুর, নাটোর, নেত্রকোনা, বাগেরহাট, বরগুনা ও নারায়ণগঞ্জের ডিসিদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ ওঠে। ঘুষ গ্রহণ, বদলি বাণিজ্য ও অর্থ কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়েছেন অনেক কর্মকর্তা।
দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টাসহ বর্তমান সরকারকে কটাক্ষ করে ফেসবুকে বিতর্কিত স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন লালমনিরহাটের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাপসী তাবাসসুম উর্মি। পরে তাকে বরখাস্ত করা হয়। আবার পুলিশের বদলি বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে যুক্ত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস। শেখ হাসিনার সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর পরই তিনি পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিতির জেরে তাকে বরখাস্ত করার পর ফেসবুকে তিনি স্ট্যাটাস দেন- নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে এমন অথর্ব সরকারের অধীনে আমাকে একদিনও চাকরি করতে হয়নি। থ্রি চিয়ার্স ফর ‘মোখলেসীয় সিভিল সার্ভিস’।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারে ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সম্প্রতি কারাগারে পাঠানো হয়েছিল কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে। পরে অবশ্য তিনি জামিন পান। চলতি বছর নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে শরীয়তপুরের ডিসি আশরাফ উদ্দিনকে সরাতে হয়। এর আগেও ডিসিদের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ মেলে। এর মধ্যে জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির, দিনাজপুরের মাহমুদুল আলম, নাটোরের গোলামুর রহমান, নেত্রকোনার মঈন উল ইসলাম, বাগেরহাটের এএনএম ফয়জুল হক, বরগুনার হাবিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের মনোজ কান্তি বড়ালের বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ ছিল। এ ছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারি, ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নানা প্রক্রিয়া শেষে ওএসডি বা বরখাস্তের মতো শাস্তি বেশি দেখা যায়। এটি সুশাসনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে পুরো ব্যবস্থাকে আসলে ঢেলে সাজাতে হবে। এ জন্য সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম।
তিন মাসের ঊর্ধ্বে অনিষ্পন্ন অভিযোগের প্রতিবেদন দ্রুত পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সম্প্রতি বিভাগীয় কমিশনারদের সমন্বয় সভায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। তবে এ নিয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমানও কথা বলতে রাজি হননি।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, প্রশিক্ষণের ঘাটতি ও পদায়নে দলপ্রীতির কারণে সরকারের মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়মিত বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও মাঠ প্রশাসনে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিঞা আমাদের সময়কে বলেন, কর্মকর্তাদের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির বড় কারণ আইন শিথিল করা। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ ও শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি ২০১৮-এর মাধ্যমে কর্মচারীদের অপরাধ প্রবণতায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে- এমনটি বলা যায়। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, আগে একদিন জেল হলেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হতো। আর এখন এক বছর জেল খাটলেও চাকরিতে পুনর্বহালের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইন সংশোধন জরুরি।
আগের আইনে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে চাকরিচ্যুত করা হতো আর এখন তিরস্কার করা হয়। শুধু তাই নয়, একাধিকবার অপরাধ করলেও শুধু তিরস্কার করা হয়। এ রকম নমনীয় আইনের কারণে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ প্রমাণিত হলেও এক বছর পর চাকরিতে যোগ দেওয়া যাবে। এসব কারণে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। দ্রুত আইনের সংশোধন করা দরকার।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন অংশীজনের নানা রকম ‘অযাচিত’ তদবির ও আবদার সামলাতে হয়। এগুলো নিয়েই বেশি সমস্যা তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ বেশি উঠে। বিভিন্ন অভিযোগে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। গুরুদ- ও লঘুদ- দেওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি বা চাকরিচ্যুতির নজির কম। এর আরেকটি কারণ ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাব বেশি থাকা। নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক শীর্ষ পদে বিশেষায়িত ক্যাডাররা বারবার উপেক্ষিত হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মাঠপর্যায়ে ইউএনও বা ডিসি হয়ে সরাসরি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত পদোন্নতি, সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগের সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধিত্বের অবারিত সুযোগ পান প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। একই ব্যাচ বা সিনিয়র হলেও অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের নির্দেশ বা পরামর্শ মানতে বাধ্য হন। এসব কারণে তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে অহমিকা ও দাপট দেখা যায়। এর জেরে অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এ জন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে নৈতিকতা। প্রশিক্ষণ মডিউলে নৈতিকতা, আচরণবিজ্ঞানসহ আরও কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা হবে, যার মূল লক্ষ্য হবে- প্রশাসনকে গতিশীল করা; যোগ্য, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের যথাস্থানে পদায়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা। একাধিক মন্ত্রণালয়ে সচিব পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া সত্ত্বেও অনেকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে পারেননি। কর্মকর্তাদের দাবি, ক্ষমতাসীনরা ‘নিজেদের মানুষ বসাতে চাইছেন’ বলেই সচিব নিয়োগে হযবরল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে। অনেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ করছেন। নিরপেক্ষ চিন্তা আরও জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। পক্ষপাতমূলক পদায়ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আইয়ুবুর রহমান খান। তাঁর মতে, প্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ করলে শাস্তি হবে না- এমন মানসিকতাই বেপরোয়া করে তোলে কর্মকর্তাদের।