নির্বাচিত ছাত্র সংসদে সভাপতির পদে অনির্বাচিত উপাচার্যরা
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (২৬ অক্টোবর) : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন পর নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি পেয়েছে। চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতির পদে আসীন রয়েছেন (পদাধিকারবলে) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তবে তারা ‘উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন’ ছাড়াই রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে অনির্বাচিত থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হলেও অনির্বাচিত উপাচার্যদের নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো কোনো উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন না হওয়ায় তা নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির জারি করা ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ’-এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে জারি থাকা চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য রয়েছে অভিন্ন আইন। সেই সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়াও প্রায় অভিন্ন। স্বাধীনতার পর এ চার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ও একাডেমিক মান নিশ্চিতসহ বেশকিছু কারণে এ অধ্যাদেশ সে সময় জারি করা হয়।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য কর্তৃক মনোনীত হবেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনেট সদস্যরা তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করবেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির কাছে সেই তালিকা পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি তিনজনের এ তালিকা থেকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও এ চার বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অনিয়মিত। এমনকি দীর্ঘ সময় স্থগিতও ছিল। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হওয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি ওঠে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-আন্দোলনের মুখে উপাচার্যদের পদত্যাগ-পলায়নের পর জোরালো দাবি ওঠে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হোক। যদিও বর্তমান সরকার দেড় বছরের বেশি সময় পার করলেও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক ড. মোর্শেদ হাসান খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো একটি নির্দিষ্ট নিয়মাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। আমরা চাইলেই কোনো ব্যক্তি বা পদকে একতরফাভাবে পরিবর্তন বা অপসারণ করতে পারি না। বর্তমান উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন সিনেট নির্বাচন সম্পন্ন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত উপাচার্য নিয়োগ বা পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ক্ষমতা সিনেটের ওপরই ন্যস্ত। আমরা চাই এ সংকটের সমাধান হোক আইনি ও নৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সিনেট নির্বাচন সম্পন্ন হলেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করা সম্ভব হবে এবং তখনই বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রশাসনিক ও একাডেমিক গতি ফিরে পাবে।’
অভিযোগ রয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নীল দলের শিক্ষকদের প্যানেল বারবার নিজেদের সুবিধামতো সিনেট সদস্য নির্বাচন করেছে। এমনকি উপাচার্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দলীয় বিবেচনাকেই সবসময় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে পরিচালিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কার্যক্রম অনিয়মিত না হলেও বিভিন্ন সময় এ প্যানেল নিয়ে সমালোচনা ছিল। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মেনে ঢাবির উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডেকে তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করেন তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তবে তখন সিনেট পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সে বছরের ১০ অক্টোবর সিনেটের সেই বিশেষ সভা ও তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেলকে অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। ছয় মাসের মধ্যে যথাযথভাবে সিনেট গঠন করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনাও দেয়া হয় সে সময়।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয় ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই। বিএনপি-পন্থী সাদা দলের অধিবেশন বর্জন এবং অন্য কোনো শিক্ষকের প্যানেল না থাকায় সে সময় অধিবেশনে কোনো ভোটাভুটি হয়নি। আওয়ামীপন্থী তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল কণ্ঠভোটে পাস হয় সে সময়।
ঢাবিতে সর্বশেষ ২০২৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সময়স্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেননি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামালকে উপাচার্য নিয়োগ দেয়। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) প্রায় এক দশক ধরে সিনেট কার্যত অচল। সর্বশেষ ২০১৬ সালের মে মাসে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মিজানউদ্দীনের সভাপতিত্বে সিনেটের ২২তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে রাবির সিনেটে আর কোনো কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সিনেট অচল থাকায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়নি। দলীয় বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এ নির্বাচনে পাঁচ ছাত্র প্রতিনিধি সিনেটে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন রাকসু ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ।
সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্যোগ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ হবে সিনেটকে পুনরায় কার্যকর করা। ফলে দ্রুত সিনেট অধিবেশন আহ্বান করা দরকার। কাল (আজ) শপথ গ্রহণের পর আমরা সিনেট সদস্যরা একসঙ্গে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। ম্যান্ডেট অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা যদি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে সিনেট সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ চান, আমরা সে দাবি উপস্থাপন করব।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন বলেন, ‘উপাচার্য নিয়োগে সর্বপ্রথম আমাদের “একাডেমিক ফ্রিডম” ফিরে পাওয়া জরুরি। কারণ এ প্রক্রিয়ার বিকল্প কিছু নেই। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের পরও সে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।’
রাবির মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনিয়মিত। দীর্ঘ আট বছর পর ২০২২ সালের আগস্টে জাবির উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আমির হোসেন প্রথম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূরুল আলম দ্বিতীয় ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার তৃতীয় হন। তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে নির্বাচিত হন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাকসু জিএস মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা এসেছি। আমাদের চাওয়া সবকিছু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হোক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিগত ১৭ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন কাঠামোই পাল্টে ফেলা হয়েছে। সিনেটেও একই অবস্থা। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিদের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সেগুলোর কিছুই সংস্কার করা হয়নি। সিনেটের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে উপাচার্য নির্বাচিত প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।’
ঢাবি ও রাবির মতো উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে আটকে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও (চবি)। আওয়ামী লীগ সরকার সেখানেও রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দলীয় সংগঠনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী সময়ে উপাচার্য নির্বাচিত হয়েছেন। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো কাঠামোতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সাঈদ বিন হাবিব তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিশেষ পরিস্থিতিতে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু আমাদের চাওয়া, অধ্যাদেশে থাকা বিধিবিধান অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালিত হোক। তাই আমরা আশা করব সংশ্লিষ্টরা শিক্ষার্থীদের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ছাত্র সংসদের সর্বাত্মক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হোক। সেটি করতেও চাকসু সদস্যরা প্রস্তুত।’
