পাঁচ বছরেও বিচার হয়নি

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় কারখানার তিনতলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন জরিনা বেগম। তখন তাঁর জীবন বাঁচলেও ডান পা আর মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। এরই মধ্যে চলে গেছে পাঁচটি বছর।

গত সপ্তাহে জরিনার ডান হাত অবশ হয়ে যায়। তিন দিন ধরে সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই গতকাল বিকেলে জরিনা বললেন, ‘আমি এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না। তাজরীনের কথা মনে পড়লেই গা শিরশির করে ওঠে। কোনো দিনই হয়তো ভয়াবহ সেই রাতের কথা ভুলতে পারব না।’

ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শুক্রবার। সেই ঘটনায় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যান। এক শর বেশি শ্রমিক আহত হন। তাঁদের অনেকেই এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। অবশ্য এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকেই শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলায় গত এক বছরে দুজন সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলায় সাক্ষী ১০৪ জন। মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জজ ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরের বছরের ডিসেম্বরে সিআইডি তাজরীনের মামলার অভিযোগপত্র দেয়। আসামিরা হলেন তাজরীনের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলামসহ ১৩ জন। তাঁদের মধ্যে চারজন পলাতক ও অন্যরা জামিনে।

তাজরীনের ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনকে বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। তবে ঠিকমতো সাক্ষী হাজির করতে না পেরে বেশ কয়েকবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।

জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী এ টি এম গোলাম গাউছ গতকাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না। সে জন্যই কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ পরিষ্কার। রাষ্ট্র ও আদালত চাইলে তাজরীনের মামলার রায় তো পাঁচ মাসেই হয়ে যেতে পারে। পাঁচ বছর লাগে না।’

তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ পোশাকশ্রমিকের পরিবার এবং আহত পোশাকশ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ও তাজরীন ক্লেইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রাস্ট। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৫৮২ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ১৬ কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। একজন নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন ক্ষতিপূরণ ছিল সাড়ে ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া আহত একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ৩ হাজার ও সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা পেয়েছে।

প্রতিবেদনের শুরুতে জরিনা বেগমের কথা বলেছিলাম। তিনি আহত হওয়ার পর আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে দেড় লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন, বাকি টাকা তাঁর স্বামী নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। দুই সন্তান নিয়ে ময়মনসিংহে বোনের বাড়িতে থাকেন জরিনা।

তাজরীনে হেলপার পদে কাজ করতেন আলেনূর। আগুন লাগার পর চারতলার জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পাশের টিনের চালের ওপর পরে বেঁচে যান। তবে মেরুদণ্ড ভেঙে যায় তাঁর। মাথা ফেটে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে তিনি মোটামুটি সুস্থ।

আলেনূর বর্তমানে রংপুরের পায়রাবন্দে শ্বশুরবাড়ি থাকেন। তাঁর স্বামী হামিদুজ্জামান গতকাল বিকেলে বলেন, ‘আলেনূর মোটামুটি সুস্থ, ঘরের টুকটাক কাজ করতে পারে। তবে প্রতিদিন তাকে ৬৫ টাকার ওষুধ খাওয়াতে হয়। এক বেলা ওষুধ না খেলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।’ তিনি বলেন, আলেনূরের চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে সব সঞ্চয় শেষ হয়েছে। ভবিষ্যতে কী হবে জানেন না তিনি।

এদিকে, তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে গতকাল গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন আলাদা বিবৃতিতে দেলোয়ার হোসেনের বিচার দাবি করেছে। ঢাকায় গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দেলোয়ার হোসেনের জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবি করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ