বিপন্নর পথে ১২ নদী

riimages

পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, নদীর তলদেশ ভরাট হওয়া, ভরাট নদীর অংশ বেদখল হয়ে যাওয়ার কারণে মৌলভীবাজার জেলার ১২ টি নদী বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে। এক সময়ের খরস্রোতা বরাক ও লংলা এবং শাখা নদী কচুয়ারখাড়া এখন রীতিমত হারিয়ে গেছে। উজানে সুইস গেইট নির্মাণের কারণে জেলার প্রধান মনু নদীর ভাটির অংশ এখন ধু ধু বালচর। রাবার ড্যামের কারণে বিপন্ন গোপলা নদী। বহু নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। ফলে এর প্রভাব পরছে মৌলভীবাজারের কৃষি জমিসহ মানুষের জীবন যাত্রায়। হুমকীর মুখে পড়েছে পরিবেশ।

জানা গেছে, খরস্রোতা নদী ও শাখা নদীর মধ্যে রাজনগরের লাঘাটা নদী ও উদনা নদী, শ্রীমঙ্গলের বিলাশ নদী ও করাঙ্গি নদী, কমলগঞ্জের লাগাটা নদী, বড়লেখার ও কুলাউড়া এবং জুড়ি উপজেলার কন্টিনালা নদী, ফানাই এবং জুড়ী নদী, মৌলভীবাজারের গোপলা নদী, বরাক ও কচুয়ারখারা নদী বিপন্ন হয়ে গেছে। ধলই নদী ও মনু নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। এরমধ্যে মৌলভীবাজারের মাতারকাপনের কাছে বাশতলা এলাকায় সুইস গেইটের কারণে মনু নদীর ভাটির অংশ শুস্ক মৌসুমে মরে গেছে। জেগে উঠে ধু ধু বালুচর।

সরেজমিন ঘুরে দেখাগেছে, সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের ফতেপুর ও নাসিরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা বরাক নদীকে এখন অর খুঁজে পাওয়া যায় না। রীতিমত খালে পরিণত হয়েছে। এ নদী ভরাট হয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে এখন লাফ দিয়ে এ নদী পাড় হওয়া যায়। নদীর ভরাট ভুমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা জবর দখল করে কোথাও কেউ কেউ ঘর বাড়ি তৈরী করেছে, আবার কোথাও হালি চারা, সবজির ক্ষেতে পরিণত করেছে। যে যার মতো পারে নদীর ভুমি দখলে নিয়ে ব্যবহার করছে। এমনও আছে, ভরাট হওয়া নদীর কোন কোন স্থানে মাটি ভরাট করে কাঁচা-পাকা ঘর বাড়ি নির্মাণ করে রীতিমত বসবাস করছে। অথচ আজ থেকে  ১৫-২০ বছর আগে এ নদী গভীর ছিল। এ নদী পথে নৌকা চলাচল করতো। ১৯৯১-৯৩ সালের দিকে এ নদীতে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। নদী পাড়ের বাসিন্দা আকমল মিয়া(৪০), রহিম উদ্দিন (৫০) জানালেন, দীর্ঘ দিন নদীটি খনন না করায় এ নদীতে চর জাগে। পরে দখলের তান্ডবে পরে এখন বরাক নদীটি হারিয়ে গেছে।

এছাড়া ক্রসবর্ডার রিভার মৌলভীবাজারের লংলা নদী হরিয়ে গেছে। এখন আর এ নদীকে খূঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি রীতিমত ছোট খালে পরিণত হয়েছে। ভরাট অংশের দখল নিয়েছে পাশ্ববর্তী জমির প্রভাবশালী মালিকরা।

কেবল বরাক নয়, হারিয়ে যাওয়ার তালিকা যুক্ত হয়ে হারিয়ে গেছে গোপলা নদীর শাখা নদী কচুয়ারখারা। কাগাবলা এলাকার এ নদীতে এখন ধান চাষ হয়। চাষাবাদের জন্য জেলার পশ্চিমাঞ্চলের গোপলা এবং পূর্বাঞ্চলের কনটিনালা নদীতে রাবার ড্যাম নির্মান করা হলেও এগুলো নদী দুটিকে বিপন্ন করে তুলেছে। তলদেশ ভরাট হয়ে গোপলা নদীর পানি প্রবাহ থামিয়ে দেয়ায় কাগাবলা বাজার থেকে ভাটি অংশ শুকিয়ে গেছে। এর প্রভাব পরেছে ভাটির অঞ্চলের বিজনা নদীতে। বিজনা নদী মৌলভীবাজার জেলার পশ্চিম সীমাšত থেকে শুরু  হয়ে হবিগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় এবং পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিপন্ন অবস্থায় আছে জেলার অন্যতম নদী ধলই, ফানাই, কন্টিনালা। এদিকে মৌলভীবাজার জেলার উত্তর সীমান্ত ঘেষে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদীও নাব্যতা কমেগেছে। কুশিয়ারার তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে গত বর্ষা মৌসুমে দেশের সর্ব বৃহৎ হাওর হাকালুকি এবং ইরিগেশন প্রকল্প ভুক্ত রাজনগরের কাউয়াদীঘী হাওরে দীর্ঘ জলাবদ্ধার সৃষ্টি হয়। শ্রীমঙ্গলের বিলাশ নদীটি কিছু অংশ এখন মৎস খামারের অংশে পরিণত হয়েছে। সরজমিনে দেখা গেছে,  দুই দিকে গড়ে ওঠা মৎস খামারের মালিকরা যে যার মতো নিজেদের প্রকল্পের ভেতর ঢুকিয়েছে নদীর ভুমি। নদীতে স্থানে স্থানে বাধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোন সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই এক মৎস খামারের মালিক বিলাশ নদীর উপরে স্থাপন করেছন পাকা কালভার্ট। ফলে অ¯িতত্ব সংকটে পড়েছে এ নদীটি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়,  বর্ষাকালে উজান থেকে স্রোতের সঙ্গে বিপুল পরিমান পলি মাটি ও বালি এসে থাকে। এসব পলি-বালি নদীর তলদেশে জমে গিয়ে নদী ধীরে ধীরে ভরাট হয়েছে। এখন এসব নদী খনন ছাড়া আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এসব নদী ড্রেজিংয়ের কোন প্রকল্প সরকারের নেই। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে একদিকে শুস্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমছে অন্যদিকে বর্ষায় বন্যার আশঙ্কা বাড়ছে। মনু নদীর পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মনু নদী প্রকল্প তেমন কাজে আসছে না। এ প্রকল্পের খাল দিয়ে পানি সরবরাহে জটিলতার কারণে প্রকল্প এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ি ৩০ হাজার একর জমিতে পানি সেচ দিয়ে পৌছানো যাচ্ছে না। ধলাই নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ৫৮ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষে ৩৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্পটিও বাস্তবায়িত হয়নি।

Leave a Reply

Facebook
%d bloggers like this:
ব্রেকিং নিউজ